Logo

আইন ও বিচার

অর্থপাচার রোধে আইন সংশোধন হচ্ছে, আছে উদ্বেগ

Icon

মাসুম আহম্মেদ

প্রকাশ: ১০ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮:০৬

অর্থপাচার রোধে আইন সংশোধন হচ্ছে, আছে উদ্বেগ

মানিলন্ডারিং বা অর্থপাচার শুধু অর্থনৈতিক অপরাধ নয়; এটি রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, সুশাসন, বিনিয়োগ পরিবেশ এবং আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তির জন্য বড় হুমকি। বাংলাদেশ গত দুই দশকে দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করলেও একই সময়ে অর্থপাচার বেড়েছে উদ্বেগজনক হারে। 

বিভিন্ন গবেষণা ও সংস্থার প্রতিবেদন বলছে, অবৈধ লেনদেন, ইনভয়েস জালিয়াতি, হুন্ডি, কর ফাঁকি এবং বিদেশে বেনামে সম্পদ সঞ্চয়ের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ দেশ থেকে বেরিয়ে গেছে, যার বেশির ভাগই আর ফেরত আসেনি। এই প্রেক্ষাপটে সরকার নতুন করে ‘মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’ প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে- যা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে পাশাপাশি কিছু মৌলিক প্রশ্ন এবং উদ্বেগও সামনে এনেছে, এমনটিই মনে করেন আইন বিশেষজ্ঞসহ সংশ্লিষ্টরা। 

জানা যায়, ২০১২ সালের মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন দীর্ঘ সময় ধরে নানা সংশোধন ও নিয়ম-বিধির মধ্য দিয়ে গেছে। কিন্তু আর্থিক খাতের দ্রুত ডিজিটাল রূপান্তর, মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস, ফিনটেক, ভার্চুয়াল অ্যাসেট, ক্রিপ্টো, বৈদেশিক বিনিয়োগের নানা পথ, আন্তর্জাতিক লেনদেনের বৈচিত্র্য- এসবের সঙ্গে তাল মেলাতে পুরোনো আইন অনেক ক্ষেত্রে অপ্রতুল হয়ে পড়েছে বলে জানান বিশেষজ্ঞরা। 

তাদের মতে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শুধু ব্যাংকিং ব্যবস্থা নয়, পুঁজিবাজার, নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান, মধ্যস্থতাকারী, রিয়েল এস্টেট, জুয়েলারি ব্যবসা- সব জায়গাতেই মানিলন্ডারিং-এর পথ তৈরি হয়েছে।

তারা আরও জানান, বিদেশে সম্পদ গড়ে তোলা, প্রবাসে পাচার করা টাকা দেশে ফেরত না আনা, বিদেশি ব্যাংকে বেনামি অ্যাকাউন্ট খোলা- এসব অপরাধের তদন্তে প্রমাণ সংগ্রহ অত্যন্ত কঠিন। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ধীর ও জটিল, অনেক দেশ তথ্য দিতে অনীহা প্রকাশ করে। ফলে আদালতে অভিযোগ প্রমাণ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। এ অবস্থায় আইনের কাঠামোকে শক্তিশালী করা সময়ের দাবি, বলে মত অনেকের। 

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, সংশোধিত অধ্যাদেশে যে বৈশিষ্ট্যগুলো সামনে এসেছে, তার মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ধারা হলো- দোষী সাব্যস্ত করতে ‘অনুমান’ বা presumption ব্যবহারের ক্ষমতা। অর্থাৎ কেউ বিদেশে সম্পদ বা অর্থ অর্জন করেছে- নিজ নামে বা অন্যের নামে- এমন অভিযোগ উঠলে আদালত ধরে নিতে পারবেন যে তিনি মানিলন্ডারিংয়ে জড়িত। তখন অভিযুক্তকেই প্রমাণ করতে হবে যে তিনি নির্দোষ।

আইনজ্ঞদের মতে, এটি নিঃসন্দেহে এক বড় পরিবর্তন, কারণ এত দিন পর্যন্ত এ ধরনের অভিযোগের প্রমাণ সম্পূর্ণভাবে রাষ্ট্রপক্ষের ওপর নির্ভর করত। কিন্তু বাস্তবে সাক্ষ্যপ্রমাণ জোগাড় করা এতটাই জটিল যে বেশির ভাগ মামলা শেষ পর্যন্ত টিকে না। সংশোধনীর লক্ষ্য সেই অবলম্বন দূর করা- যাতে আদালত অভিযোগের যথেষ্ট ভিত্তি পেলেই বিচার এগিয়ে নিতে পারে।

আরেকটি বড় পরিবর্তন হলো- পুঁজিবাজার ও নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধে নতুন নজরদারি কাঠামো তৈরি করা। এতে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)-কে প্রথমবারের মতো অর্থপাচার সম্পর্কিত তদন্ত, পর্যালোচনা এবং মামলা পরিচালনার ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে ব্রোকার হাউস, ডিলার, মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে টাকার ছদ্মবেশী লেনদেন, কৃত্রিম লাভ দেখানো, শেয়ার কারচুপি করে টাকা বিদেশে পাঠানোর অভিযোগ উঠেছে।

সংশোধনীর ফলে এসব খাতের ওপর নিয়ন্ত্রণ বাড়বে এবং তদন্তও আরও লক্ষণীয় হবে বলেই মত অর্থনীতিবিদদের। নতুন বিধানে, যেসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নিয়ম-বহির্ভূত লেনদেন করে বা সন্দেহজনক আর্থিক কার্যক্রমে জড়িত থাকে, তাদের ওপর নজরদারি এবং বাধ্যতামূলক রিপোর্টিং- উভয়ই কঠোর করা হচ্ছে। ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ), দুদক, এনবিআর, বিশেষ পুলিশ ইউনিট- সব সংস্থার সমন্বিত ভূমিকাকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

সংশোধনের সুফল কী হতে পারে: অর্থনীতিবিদ ও আইনজ্ঞদের মতে, অবৈধ সম্পদ বিদেশে গচ্ছিত রেখে কেউ যাতে দেশে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে না পারে- এই বার্তাটি শক্তভাবে যাবে। দীর্ঘদিন ধরে অর্থপাচারকারীরা আইন ও তদন্তের দুর্বলতার সুযোগ নিয়েছে। ‘প্রমাণ করো আমি দোষী’- এই অবস্থান বদলে গিয়ে এখন ‘প্রমাণ করো তুমি নির্দোষ’- এই কাঠামো তৈরি হলে অপরাধ দমনে বাস্তব পরিবর্তন হতে পারে।

তারা আরও জানান, দ্বিতীয়ত, পুঁজিবাজারে স্বচ্ছতা বাড়বে। যেসব প্রতিষ্ঠান মানিলন্ডারিংয়ের নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে পুঁজিবাজার ব্যবহার করত, তাদের ওপর নিয়ন্ত্রণ বাড়বে। এর ফলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীর আস্থা বাড়তে পারে।

তারা মনে করেন, রাষ্ট্রের আর্থিক শৃঙ্খলা উন্নত হবে। কর রাজস্ব বাড়াতে সাহায্য করবে এবং বৈদেশিক লেনদেনে স্বচ্ছতা নিশ্চিত হবে। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার অন্যতম পূর্বশর্ত হলো- অর্থ কোথা থেকে এলো, কোথায় গেল- এ বিষয়ে সঠিক তথ্য রাখা। সংশোধিত আইন সে পথ সহজ করবে বলেই মত অনেকের।

তবু কিছু উদ্বেগ অস্বীকার করা যায় না: প্রতিটি কঠোর আইনের মতোই এই সংশোধনীরও কিছু ঝুঁকি আছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।  

ভুক্তভোগীসহ দেশের আইন ও অর্থনীতি সংশ্লিষ্ট অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সবচেয়ে বড় উদ্বেগ- ‘অনুমান’ ভিত্তিক দোষী সাব্যস্ত করার বিধান। বিচারবিজ্ঞানে এটি একটি ব্যতিক্রমধর্মী পদ্ধতি। বিশ্বের অনেক দেশে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে এই পদ্ধতি ব্যবহার হয়, কিন্তু সেখানে তদন্ত ব্যবস্থা শক্তিশালী, জবাবদিহি নিশ্চিত এবং বিচারকাজে উচ্চমানের পেশাদারিত্ব রয়েছে।

দেশের তদন্ত সক্ষমতা, বিশেষজ্ঞ জনবল, আন্তর্জাতিক তথ্যপদ্ধতির সঙ্গে সংযোগ- এসব এখনো কাক্সিক্ষত পর্যায়ে পৌঁছায়নি। ফলে ভুল ব্যক্তি হয়রানির আশঙ্কা থাকে। রাজনৈতিক প্রভাব বা ব্যক্তিগত শত্রুতার কারণে আইন অপব্যবহারের আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

অনেকের মনেই প্রশ্ন- নতুন ক্ষমতা পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো কতটা নিরপেক্ষ ও দক্ষভাবে কাজ করবে? যেমন বিএসইসি বা তদন্ত সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে অতীতে রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক চাপের অভিযোগ শোনা গেছে। ক্ষমতা বাড়লে জবাবদিহিও বাড়াতে হবে- নইলে আইন ব্যর্থ হবে। বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশের খবরকে বলেন, সংশোধনী কার্যকর করার পাশাপাশি কিছু মৌলিক বিষয় নিশ্চিত করা জরুরি।

স্বচ্ছ ও ন্যায্য তদন্ত প্রক্রিয়া- বিশেষ প্রশিক্ষিত জনবল, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও ডিজিটাল নজরদারি জোরদার করতে হবে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার সক্ষমতা বৃদ্ধি- বিএসইসি, বিএফআইইউ, দুদক- সব সংস্থাকে প্রযুক্তিগত, মানবিক ও প্রক্রিয়াগত দক্ষতায় সমৃদ্ধ করা জরুরি। রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত আইন প্রয়োগ- আইনের সামনে সবাই সমান- এই মূলনীতির ব্যত্যয় ঘটলে সংশোধনীর উদ্দেশ্যই নষ্ট হবে।

এ ছাড়া জনসচেতনতা ও গণমাধ্যমের ভূমিকা আর্থিক অপরাধ রোধে সমাজের নজরদারি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।  তারা মনে করছেন, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বাড়ানো অর্থাৎ বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা এবং তথ্য পাওয়ার জন্য বৈশ্বিক নেটওয়ার্ককে আরও কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে হবে। সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী বলেন, মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিঃসন্দেহে সময়োপযোগী এবং জরুরি।

রাষ্ট্রের অর্থনীতি, আস্থা, স্থিতিশীলতা এবং আন্তর্জাতিক সুনাম রক্ষার জন্য শক্তিশালী আইনি কাঠামো প্রয়োজন। তবে কঠোর আইনই সবসময় ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে না; সঠিক প্রয়োগ, দক্ষতা, প্রাতিষ্ঠানিক স্বচ্ছতা এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছাই আইনকে কার্যকর করে। তিনি বলেন, অপরাধীকে শাস্তি দিতে হবে কিন্তু নির্দোষ মানুষের অধিকারও রক্ষা করতে হবে। এই দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখাই হবে নীতি-নির্ধারকদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। যদি তা নিশ্চিত করা যায়, তবে এই সংশোধনী সত্যিই অর্থপাচার প্রতিরোধে নতুন যুগের সূচনা করতে পারে।

এনএ

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

দুর্নীতি দমন কমিশন

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর