Logo

আইন ও বিচার

জমি রেজিস্ট্রেশনে স্ট্যাম্প ফি কম দেওয়া, সর্বোচ্চ সাত বছর কারাদণ্ড

Icon

আইন ও আদালত ডেস্ক

প্রকাশ: ১০ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮:৫৯

জমি রেজিস্ট্রেশনে স্ট্যাম্প ফি কম দেওয়া, সর্বোচ্চ সাত বছর কারাদণ্ড

জমি ও সম্পত্তি রেজিস্ট্রেশন বাংলাদেশের একটি সংবেদনশীল প্রশাসনিক ক্ষেত্র। এখানে স্বচ্ছতা নিশ্চিত না হলে শুধু ক্রয়- বিক্রয়ই নয়, রাষ্ট্রীয় রাজস্ব, ভূমি প্রশাসন এবং বিচারব্যবস্থার ওপরও এর গভীর প্রভাব পড়ে।

আমাদের দেশে বহু বছর ধরে একটি প্রচলিত কৌশল, দলিলে প্রকৃত মূল্য গোপন রেখে কম স্ট্যাম্প–শুল্ক দিয়ে রেজিস্ট্রি করানো এখনও অনেক অঞ্চলে চলছে। এটি অনেকের কাছে ‘সাধারণ প্র্যাকটিস’ মনে হলেও আইনের চোখে এটি রাজস্ব ফাঁকি, মিথ্যা বিবৃতি, এবং প্রতারণা; যার শাস্তি অত্যন্ত  কঠোর।

Registration Act, ১৯০৮- এর ৮১ ও ৮২ ধারার প্রতি সাধারণ মানুষের অজ্ঞতা এবং প্রশাসনিক শিথিলতা মিলে পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। আমরা যখন জমি ক্রয় করি, তখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দলিল হলো রেজিস্ট্রি। এটি কেবল ক্রয়-বিক্রয়ের আইনি বৈধতা দেয় না, ভবিষ্যতে বিরোধ দেখা দিলে অধিকার ও মালিকানার প্রমাণ হিসেবেও কাজ করে। 

অথচ এখানেই সমস্যা শুরু হয় অনেক ক্ষেত্রেই ক্রেতা ও বিক্রেতা দু’পক্ষই উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে প্রকৃত মূল্য কম দেখান, যাতে স্ট্যাম্প ডিউটি এবং রেজিস্ট্রেশন ফি কম পড়ে। কেউ কেউ মনে করেন `এটা করতে সবাইই তো করে'- কিন্তু বাস্তবে এই ছোট ‘ছাড়’ ভবিষ্যতে বড় বিপদে ফেলতে পারে।

Registration Act-এর ধারা ৮২- অনুযায়ী, রেজিস্ট্রেশনের সময় যদি কেউ মিথ্যা বিবৃতি দেন, দলিলে জেনে-বুঝে ভুল তথ্য প্রদান করেন, মূল্য গোপন করেন বা ফাঁকি দেন, তবে তিনি সর্বোচ্চ সাত বছর পর্যন্ত  সশ্রম কারাদণ্ড, জরিমানা, অথবা উভয় দণ্ডেই দণ্ডিত হতে পারেন। অর্থাৎ, দলিল রেজিস্ট্রির উদ্দেশ্যে প্রকৃত লেনদেনমূল্য না জানানো আইনের ভাষায় ‘false statement’- যা শাস্তিযোগ্য।

একইভাবে, ধারা ৮১ বলছে, যদি কোনো রেজিস্ট্রার বা সরকারি কর্মকর্তা জেনেশুনে ভুল দলিল endorse বা register করেন, এবং তাতে জনসাধারণ বা ব্যক্তির ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে, তবে সেই কর্মকর্তাও একই মাত্রার শাস্তির মুখোমুখি হবেন।

এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো স্ট্যাম্প শুল্ক সরকারি রাজস্বের একটি উল্লেখযোগ্য উৎস। এই রাজস্ব দিয়েই রাষ্ট্রের অবকাঠামো, সেবা এবং উন্নয়ন প্রকল্পগুলো পরিচালিত হয়। তাই এটি ফাঁকি দেওয়া মানে রাষ্ট্রের অধিকার ক্ষুণ্ন করা। অর্থাৎ, স্ট্যাম্প কম দিয়ে দলিল রেজিস্ট্রি করানো কখনোই ‘পারিবারিক সুবিধা’ বা ‘ব্যক্তিগত বুদ্ধিমত্তা’ নয়; এটি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপরাধ।

এ ছাড়া, কম মূল্যে দলিল নিবন্ধনের মাধ্যমে আপাতদৃষ্টিতে আর্থিকভাবে লাভবান হলেও দীর্ঘমেয়াদে এটি বিপদ ডেকে আনে। কারণ, ভবিষ্যতে যদি কোনো বিরোধ সৃষ্টি হয় বা পুনরায় লেনদেন করতে হয়, তখন এই কম মূল্যই উল্টো দায় হয়ে দাঁড়ায়। সম্পত্তির প্রকৃত মূল্য প্রমাণ করতে সমস্যা হয়, আদালতে গেলে নথিপত্রের অসঙ্গতি নেতিবাচক অবস্থান তৈরি করে, আর প্রশাসনিক তদন্তে ফাঁকি ধরা পড়লে আবার অতিরিক্ত করসহ জরিমানাও গুণতে হয়।

রেজিস্ট্রি অফিসে বহু বছর ধরে যে অনিয়মের সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল, সাম্প্রতিক সময়ে সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে সেটি ভাঙার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। স্ট্যাম্প ফি কমিয়ে দলিল রেজিস্ট্রি করানো এবং অফিসে দালালচক্রের মাধ্যমে এই অনিয়ম সহজ করার প্রবণতা চিহ্নিত হয়েছে। অনেক রেজিস্ট্রার ও কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এই উদ্যোগ শুধু অনিয়ম কমানোর জন্যই নয়; বরং ভূমি ব্যবস্থাপনায় একটি স্বচ্ছ ও আধুনিক কাঠামো তৈরির জন্য জরুরি।

তবে এখানেই শেষ নয়। সমস্যা শুধু আইন প্রয়োগের নয়- জনসচেতনতারও। অধিকাংশ মানুষ এখনো জানেন না যে দলিলে কম মূল্য দেখানো একটি ফৌজদারি অপরাধ। আইনজীবী, দলিল লেখক এবং দালাল- অনেকেই সুবিধার জন্য বা ব্যবসায়িক স্বার্থে মানুষকে ভুল পথে পরিচালিত করেন। ফলে সাধারণ মানুষ মনে করেন এটি একটি ‘সবার করা নিয়ম’- যা বাস্তবিকই ভুল। জমি-সম্পত্তির লেনদেন একটি জীবনপর্যায়ের বড় সিদ্ধান্ত। এখানে ক্ষুদ্র অনিয়মও ভবিষ্যতের মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়ায়। তাই জনগণের সচেতন হওয়া অত্যন্ত  জরুরি।

এই প্রসঙ্গে সরকারের ভূমিকা আরও শক্তিশালী হওয়া প্রয়োজন। ভূমি অফিসগুলোতে ডিজিটাল প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা, দালালমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা, স্বয়ংক্রিয় মূল্যায়ন (automated valuation) ব্যবস্থার উন্নয়ন, এবং অভিযোগ গ্রহণ ও সমাধানের স্বচ্ছ প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলা জরুরি। এতে রাজস্ব বাড়বে, দুর্নীতি কমবে, আর জনগণের আস্থা বৃদ্ধি পাবে।

স্ট্যাম্প-ডিউটি কম দেওয়া বা মূল্য গোপন করা শুধু একটি প্রযুক্তিগত ভুল নয়; এটি সামাজিক ও আইনগতভাবে গুরুতর অপরাধ। Registration Act, ১৯০৮–এর কঠোর শাস্তির বিধান সেই সতর্কবার্তাই দেয়- কোনোভাবেই দলিল রেজিস্ট্রেশনে অনিয়ম বরদাস্ত করা হবে না। জনগণকে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে, আর প্রশাসনকে নিশ্চিত করতে হবে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি। জমির বৈধতা নিশ্চিত করতে, ভবিষ্যৎ বিরোধ এড়াতে এবং রাষ্ট্রের রাজস্ব সুরক্ষায় এটি এখন সময়ের দাবি।

একটি দায়িত্বশীল, আধুনিক ও ন্যায়ভিত্তিক ভূমি ব্যবস্থার দিকে এগিয়ে নিতে হলে- “স্ট্যাম্প কম দেওয়ার সংস্কৃতি” অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। আইন ইতিমধ্যেই কঠোর; এখন প্রয়োজন আমাদের সচেতনতা, সাহস এবং সঠিক পথ অনুসরণের অঙ্গীকার।

এনএ

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

আইন ও আদালত

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর