রোগীর মৃত্যু গোপন রাখলে চিকিৎসক ও হাসপাতালের আইনগত দায়
আইন ও আদালত ডেস্ক
প্রকাশ: ১০ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯:৪৪
দেশে রোগীর অধিকার, চিকিৎসকের দায়িত্ব ও হাসপাতাল ব্যবস্থাপনার জবাবদিহিতা নিয়ে জনসচেতনতা এবং আইনি কাঠামো ক্রমশ বিস্তৃত হয়েছে। রোগী যখন চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হয়, তখন তার নিরাপত্তা, সঠিক তথ্য জানার অধিকার, এবং প্রয়োজনে নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রাখা হাসপাতালের মৌলিক দায়িত্ব।
রোগীর মৃত্যু হলে তা চিকিৎসা-নৈতিকতা এবং আইনের দৃষ্টিতে অবিলম্বে পরিবারের নিকটাত্মীয়কে জানানো বাধ্যতামূলক। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, হাসপাতাল বা চিকিৎসক বিভিন্ন উদ্দেশ্যে- অর্থ আদায়, আইনি জটিলতা এড়ানো, ভুল চিকিৎসা গোপন করা, কিংবা প্রশাসনিক অসুবিধা এড়াতে- মৃত্যুর খবর গোপন রাখেন। এটি শুধু নৈতিক লঙ্ঘনই নয়; বাংলাদেশের বিভিন্ন আইনে এসব কাজকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
রোগীর মৃত্যু ঘোষণার নৈতিক ও পেশাগত ভিত্তি :
BMDC (বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিল) আচরণবিধি- BMDC আচরণবিধিতে চিকিৎসকদের জন্য স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। রোগীর অবস্থা সম্পর্কে সঠিক ও নির্ভরযোগ্য তথ্য পরিবারকে দিতে হবে। রোগীর মৃত্যু হলে অবিলম্বে আইনগত উত্তরাধিকারী বা অভিভাবককে জানাতে হবে। ভুল তথ্য প্রদান, মৃত্যু গোপন করা বা বিলম্বিত ঘোষণা পেশাগত অসদাচরণ। অর্থাৎ, মৃত্যু গোপন করা BMDC অনুযায়ী `Professional Misconduct' এবং এতে চিকিৎসকের নিবন্ধন স্থগিত বা বাতিল হতে পারে।
বাংলাদেশে প্রযোজ্য আইনসমূহের আলোকে দায়বদ্ধতা :
রোগীর মৃত্যু গোপন করা বা ঘোষণা না দেওয়ার ঘটনা একাধিক আইনের আওতায় অপরাধ হতে পারে। নিচে সংশ্লিষ্ট আইন অনুযায়ী দায় ও শাস্তি বর্ণনা করা হলো:
৩.১ দণ্ডবিধি, ১৮৬০ (চবহধষ ঈড়ফব, ১৮৬০)
৩.১.১ ধারা ২০১- অপরাধের তথ্য গোপন করা। যদি মৃত্যু গোপন করার উদ্দেশ্যে হাসপাতালে তথ্য আড়াল করা হয়, মেডিকেল রিপোর্টে ভুল তথ্য দেওয়া হয়, বা মৃত্যুর সময় পরিবর্তন করা হয়, তবে তা `অপরাধ লুকানোর প্রচেষ্টা' হিসেবে গণ্য হবে। শাস্তি: কারাদণ্ড বা জরিমানা। ৩.১.২ ধারা ১৮৬/১৮৯- সরকারি দায়িত্বে বাধা সৃষ্টি করা। মেডিকেল ডেথ সার্টিফিকেট বা রিপোর্ট ভুল তৈরি করা হলে তা সরকারি নথি বিকৃতি হিসেবে অপরাধ গণ্য হতে পারে।
৩.১.৩ ধারা ৪১৭ / ৪২০- প্রতারণা (Cheating & Fraud) যদি মৃত্যু গোপন রেখে চিকিৎসা বিল বাড়ানো, ভেন্টিলেশন বা ICU চার্জ বাড়ানো, পরিবারকে ভুল ধারণায় রেখে চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া- এসব প্রতারণা হিসেবে গণ্য হবে। শাস্তি: কারাদণ্ড ও জরিমানা। ৩.১.৪ ধারা ৪৬৬/৪৬৮- জালিয়াতি ও ভুয়া নথি প্রণয়ন। মৃত্যুর সময় পরিবর্তন, নথি সংশোধন, ফাইল লুকানো, বা রোগীর মৃত্যু সনদে ভুল তথ্য দেওয়া- এই ধারার অধীনে শাস্তিযোগ্য। ৩.১.৫ ধারা ৩০৪এ- অবহেলার কারণে মৃত্যু।
যদি গাফিলতি বা ভুল চিকিৎসার কারণে মৃত্যু ঘটে এবং সেটি গোপন করা হয়, তবে চিকিৎসকের বিরুদ্ধে `causing death by negligence' মামলা হতে পারে। ৩.২ ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ : রোগীকে ভোক্তা হিসেবে ধরা হয়। রোগীর মৃত্যু গোপন করা ভোক্তার অধিকার লঙ্ঘনের শামিল। ভুল তথ্য প্রদানের অপরাধ, প্রতারণামূলক ব্যবসায়িক আচরণ, নৈতিক ক্ষতির জন্য ক্ষতিপূরণ পাওয়ার অধিকার।
শাস্তি: হাসপাতালের বিরুদ্ধে জরিমানা, ক্ষতিপূরণ আদায় এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থা : ৩.৩ স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও হাসপাতাল লাইসেন্সিং আইন- হাসপাতালের দায়িত্ব হলো রোগীর অবস্থা সঠিকভাবে নথিভুক্ত করা, মৃত্যু হলে মৃত্যু রেজিস্টার পূরণ করা, নিকটাত্মীয়কে তাৎক্ষণিকভাবে জানানো।
এসব দায়িত্ব লঙ্ঘন করলে হাসপাতালের লাইসেন্স স্থগিত, অনুমোদন বাতিল, প্রশাসনিক তদন্ত । ৩.৪ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন / ডেটা সুরক্ষা আইন। যদি হাসপাতাল ডিজিটাল রেকর্ডে মৃত্যুর তথ্য বিকৃত করে, ডেটা চেপে রাখে বা ভুল তথ্য প্রদর্শন করে, তবে এটি ডিজিটাল প্রতারণা এবং ডেটা সুরক্ষা আইন অনুযায়ী অপরাধ।
হাসপাতাল ব্যবস্থাপনার দায়: ৪.১ কর্পোরেট অবহেলা (Corporate Negligence)- হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা যদি তথ্য গোপনে চিকিৎসককে উৎসাহ দেয়, নথি গোপন করে, প্রশাসনিকভাবে বিলম্ব সৃষ্টি করে, তাহলে হাসপাতালের বিরুদ্ধে `কর্পোরেট অবহেলা' মামলা হতে পারে। ৪.২ সিভিল দায় : পরিবার ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারে। মানসিক কষ্ট, চিকিৎসা খরচ, ভুল তথ্যপ্রদানের ক্ষতি। ৪.৩ ক্রিমিনাল দায়- প্রয়োজনে হাসপাতালের পরিচালক, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, ডিউটি ম্যানেজারের বিরুদ্ধেও অভিযোগ দায়ের করা যায়।
চিকিৎসকের দায়বদ্ধতা : চিকিৎসকের ব্যক্তিগত দায় কয়েক ভাগে বিভক্ত: পেশাগত দায়, BMDC-এর আচরণবিধি লঙ্ঘন, নিবন্ধন স্থগিত বা বাতিল, ফৌজদারি দায় : ধারা ২০১: তথ্য গোপন, ধারা ৪১৭/৪২০: প্রতারণা, ধারা ৪৬৮: জালিয়াতি, ধারা ৩০৪এ: গাফিলতির মাধ্যমে মৃত্যু, দেওয়ানি দায় : আর্থিক ক্ষতিপূরণ, অভিযোগকারীর পরিবারকে মানসিক ক্ষতির ক্ষতিপূরণ প্রদান।
রোগীর অধিকার লঙ্ঘনের দিক : বাংলাদেশ Patient Rights Charter- অনুযায়ী, তথ্য জানার অধিকার, রোগীর রেকর্ড পাওয়ার অধিকার, সম্মান ও নিরাপত্তার অধিকার, পরিবারকে সময়মতো অবহিত করার অধিকার। মৃত্যু গোপন করা এ সকল অধিকার লঙ্ঘন করে।
মৃত্যু গোপন করার সম্ভাব্য কারণ ও সেগুলোর আইনগত মূল্যায়ন : সম্ভাব্য কারণ মূল্যায়ন আইনগত অবস্থা, ভুল চিকিৎসা আড়াল করা গুরুতর অসদাচরণ ফৌজদারি মামলা হতে পারে। বিল বাড়ানোর উদ্দেশ্যে মৃত্যু গোপন প্রতারণা দণ্ডবিধি ৪২০ ধারা। রোগীর মৃত্যু গোপন রাখা কোনও পরিস্থিতিতেই নৈতিক বা আইনি দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য নয়। এটি চিকিৎসকের পেশাগত দায়িত্ব লঙ্ঘন, রোগীর অধিকার ক্ষুণ্ন করা এবং একাধিক আইনের আওতায় দণ্ডনীয় অপরাধ।
বাংলাদেশের দণ্ডবিধি, BMDC আচরণবিধি, ভোক্তা অধিকার আইন এবং হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা বিধিমালা- সব মিলিয়ে মৃত্যু গোপন করার দায় অত্যন্ত কঠোর এবং বহুমাত্রিক। সুতরাং, চিকিৎসক ও হাসপাতালের জন্য স্পষ্ট বার্তা হলো- স্বচ্ছতা, সময়মতো তথ্য প্রদানের বাধ্যবাধকতা এবং সঠিক ডকুমেন্টেশনই আইনগত দায় থেকে মুক্ত থাকার একমাত্র উপায়।

