Logo

আইন ও বিচার

হাইওয়েতে মৃত্যুর মিছিল থামছে না

আইন আছে, বাস্তবায়ন কোথায়?

Icon

মাসুম আহম্মেদ

প্রকাশ: ১১ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮:১৬

হাইওয়েতে মৃত্যুর মিছিল থামছে না

দেশের হাইওয়ে আজ একটি অনিরাপদ করিডোরে পরিণত হয়েছে। যেখানে প্রতিদিন প্রাণহানি আর আহতের সংখ্যা বাড়ছে, আর গতিনিয়ন্ত্রণ আইন কেবল কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ থাকছে। সড়ক পরিবহন আইন, BRTA-র নতুন গতি সীমা গাইডলাইন, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার নানামুখী ঘোষণা- সবই আছে; নেই শুধু বাস্তবায়ন। এর ফলে দেশের গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কগুলোতে ‘গতি’ যেন এক ভয়ঙ্কর সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তবে প্রশ্ন হচ্ছে- দেশে গতি-নিয়ন্ত্রণ আইন এত উন্নত হওয়া সত্ত্বেও কেন বাস্তবে ফল মিলছে না? কেন হাইওয়ে আজও আগের চেয়েও ভয়ংকর? 

গতি-নিয়ন্ত্রণ আইন: কাগজে শক্তিশালী, মাঠে দুর্বল :

২০২৪ সালে BRTA ‘Motor Vehicle Speed Limit Guideline, ২০২৪” জারি করে। এতে রাস্তা, প্রকার ও যানবাহনের ধরণ অনুযায়ী নতুন গতি-সীমা নির্ধারণ করা হয় । যেমন- জাতীয় এক্সপ্রেসওয়েতে গাড়ির সর্বোচ্চ গতি: ৮০ কিমি/ঘণ্টা। মোটরসাইকেল: ৫০-৬০ কিমি/ঘণ্টা (রাস্তাভেদে)। ট্রাক ও ভারি যান: ৪৫-৫০ কিমি/ঘণ্টা। শহরে সর্বোচ্চ: ৩০-৪০ কিমি/ঘণ্টা (যানভেদে)।

এছাড়া স্কুল, হাসপাতাল, বাজার এলাকায় আরও কম গতিতে চালানোর নির্দেশ দেওয়া আছে। সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮ অনুযায়ী গতি-সীমা অমান্য করলে তিন মাসের কারাদণ্ড বা ১০,০০০ টাকা জরিমানাও হতে পারে।

এ সম্পর্কে জানতে চাইলে সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ আলী বাংলাদেশের খবরকে বলেন, “আইন কাগজে কঠোর এতে সন্দেহ নেই। সমস্যা হচ্ছে জবাবদিহি ও প্রয়োগে।” ২০১৪-২০২৫: ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান বলছে আইন আছে, নিয়ম মানা হয় না। গত ১২ বছরে প্রায় ৬৭,৮৯০ দুর্ঘটনায় ১,১৬,৭২৬ জন নিহত এবং ১,৬৫,০২১ জন আহত- এমন তথ্য দিয়েছে যাত্রী কল্যাণ সমিতি। শুধু ২০২৪ সালে দুর্ঘটনা হয়েছে ৬,৩৫৯টি; মৃত্যু ৮,৫৪৩ জন, আহত ১২,৬০৮ জন- এ তথ্য একটি বেসরকারি উৎস জানিয়েছে ।

কিন্তু BRTA একই বছরের জন্য মৃত্যুর সংখ্যা দেখিয়েছে ৫,৪৮০ জন অর্থাৎ এক উৎসের সঙ্গে আরেক উৎসের পার্থক্য প্রায় ৩,০০০ জন ।

২০২৩ সালে BRTA-র হিসাবে নিহত হয় ৫,০২৪ জন, আহত ৭,৪৯৫ জন- এ হলো সরকারি সংখ্যা। আর ২০২৫ সালের জুলাইয়ে এক মাসেই ৪২৭ দুর্ঘটনায় ৩৮০ জন নিহত, ৫৪২ জন আহত- যা ভীতিকর প্রবণতাই ইঙ্গিত করে ।

এই পরিসংখ্যান শুধু মৃত্যু নয়- নিরাপত্তা ব্যর্থতার গভীর সংকটকে নগ্নভাবে সামনে আনে। তথ্য সংগ্রহে অসমতা, রিপোর্টিং-এর অপূর্ণতা, এবং দুর্ঘটনার প্রকৃত চিত্র লুকিয়ে যাওয়ার প্রবণতা। সব মিলিয়ে সড়ক পরিবহন ব্যবস্থায় ভয়াবহ শৃঙ্খলাহীনতার পরিচয় দেয়।

কেন আইন থাকা সত্ত্বেও হাইওয়েতে মৃত্যু কমছে না? : 

বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ ও আইনজীবী এবং  ছাত্র সমাজের নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘বাংলাদেশের হাইওয়েগুলোতে মৃত্যু কমছে না কারণ বেশিরভাগই পর্যবেক্ষণহীন সড়ক গতি নিয়ন্ত্রণ কাগজে, রাস্তায় নয়। সড়ক বাস্তবতায় গতি-সীমা বোর্ড অনেক স্থানে নেই। যেখানে আছে, সেগুলো মানার প্রবণতা নেই। ট্রাফিক পুলিশের নজরদারি অপর্যাপ্ত, মোবাইল কোর্ট কম, ওভারস্পিডিং শনাক্ত করার ইলেকট্রনিক ব্যবস্থা নেই। ফলে গতিসীমা যে পরামর্শ-এমনটাই মনে করে চালকরা।’

রাস্তার ধরন ও যানবাহনের মিশ্রণ অবিন্যস্ততা রয়েছে। একই লেনে চলে বাস, ট্রাক, কার, মোটরসাইকেল, অটোরিকশা, ইজি-বাইক, পণ্যবাহী ভ্যান মাঝে মাঝে পশুবাহী গাড়িও। দ্রুতগামী ও ধীরগামী যান এক লেনে চললে দুর্ঘটনা না বাড়ে কী করে?

তথ্য সংগ্রহে বৈষম্য- সমস্যার গভীরতা আড়াল হয়। ২০২৪ সালের মৃত্যুর ডেটায় উৎসভেদে হাজারের ওপর পার্থক্য-এটা সড়ক নিরাপত্তা পর্যবেক্ষণের ব্যর্থতা। রয়েছে দূর্বল মনিটরিং ও চালকদের আচরণ। অতিরিক্ত গতি চালানোকে ‘দক্ষতা’ ভাবা, চ্যালেঞ্জ নেওয়া, দ্রুত পৌঁছানোর তাড়না-এসব অভ্যাসগত সমস্যা। স্পিড লিমিট মানাকে অধিকাংশ চালক সময় ক্ষেপণ মনে করে।

রাস্তাপ্রকল্পনায় বৈজ্ঞানিক পরিকল্পনার অভাব :

বেশিরভাগ হাইওয়েতে আলাদা মোটরসাইকেল লেন নেই। আলাদা ধীরগামী যান লেন নেই। ওভারটেকিং জোন চিহ্নিত নেই। নাইট-টাইম রিফ্লেকটিভ সাইন নেই। এগুলো ছাড়া গতি-নিয়ন্ত্রণ সম্ভবই নয়।

ওভারস্পিডিং- বাংলাদেশে সড়ক মৃত্যুর সবচেয়ে 

বড় কারণ : 

২০২৪ সালের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে মোট দুর্ঘটনার ৩৬.৬২ শতাংশ মোটরসাইকেল সংশ্লিষ্ট। মোট নিহতের ৩০.০৮ শতাংশ মোটরসাইকেল চালক বা আরোহী গতি-সীমা না মানা এবং নিরাপত্তা সচেতনতার অভাব এর প্রধান কারণ।

গতি-সীমা: কার্যকারিতা নিশ্চিতের জন্য যা জরুরি : 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের হাইওয়ে নিরাপদ হবে যখন পাঁচটি মৌলিক বাস্তবায়ন নিশ্চিত হবে। স্পিড-লিমিট সাইন বাধ্যতামূলক করা, রাস্তায় স্পষ্ট, বড়, প্রতিফলকযুক্ত (reflective) সাইন প্রয়োজন, বৈজ্ঞানিক রাস্তাপ্রকল্পনা, দ্রুতগামী ও ধীরগামী যান আলাদা লেন, বাইক লেন, রাতের সড়কে LED সাইন, ওভারটেকিং জোন, ফুটওভার ব্রিজ ও আন্ডারপাস, ইলেকট্রনিক মনিটরিং, স্পিড ক্যামেরা, স্মার্ট ট্রাফিক সিস্টেম, গতি-ভঙ্গের অটোমেটিক জরিমানা ব্যবস্থা। ট্রাফিক পুলিশের নিয়মিত অভিযানসহ মোবাইল কোর্ট বৃদ্ধি, রাতের অভিযান ও সপ্তাহভিত্তিক পর্যবেক্ষণ দুটোই প্রয়োজন। এছাড়া গতি কমানোকে দক্ষতা ও শৃঙ্খলার অংশ হিসেবে সমাজে প্রচার করতে হবে।

আইন আছে, কিন্তু আইন মানার পরিবেশ নেই :

বাংলাদেশে মূল সংকটটি আইন না থাকা নয়। আইন থাকলেও, তার প্রয়োগের অভাব। যদি স্পিড লিমিট লঙ্ঘন করলেও কেউ শাস্তি না পায়, তাহলে চালকদের আচরণ পরিবর্তন সম্ভব নয়। এ কারণেই দেশে দুর্ঘটনার পরিসংখ্যানে উন্নতি দেখা যাচ্ছে না। বরং ২০২৫ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী আইন না মানার প্রবণতা বাড়ছে, কমছে না ।

হাইওয়ে: উন্নয়নের সঙ্গী না, মৃত্যুর ফাঁদ? :

বাংলাদেশের অর্থনীতি, বাণিজ্য, শিল্প, কর্মসংস্থান সবই নির্ভর করে সড়ক যোগাযোগের ওপর। এ দেশে মোট যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের ৮০ শতাংশ-এর বেশি চলে সড়কপথে। তাই হাইওয়ের নিরাপত্তাহীনতা শুধু প্রাণহানি নয়, এটি অর্থনীতির ক্ষতি, পরিবার ধ্বংস, জাতির ক্ষতি। প্রতিদিন ১৪-১৮ জন নিহত হওয়া কোনো সভ্য দেশে গ্রহণযোগ্য নয়-এটা জরুরি জাতীয় সংকট।

অনেকে বলছেন, এখনই কঠোর প্রয়োগ প্রয়োজন, নইলে সামনে আরও ভয়াবহ পরিস্থীতির সম্মুক্ষীণ হতে হবে।

বাংলাদেশে হাইওয়ে-নিরাপত্তা শুধু কোনও আইন বা প্রশাসনিক দায়িত্ব নয়-এটি একটি নাগরিক, সামাজিক ও মানবিক দায়বদ্ধতা। রাষ্ট্র যদি গতি-সীমা নির্ধারণ করে, কিন্তু বাস্তবে প্রয়োগ না করে, তাহলে মৃত্যু-মিছিল চলতেই থাকবে। সড়ক নিরাপত্তা কোনো বিলাসিতা নয়, এটি মানুষের বাঁচার অধিকার। আজ সময় এসেছে নীতিগত সিদ্ধান্তকে বাস্তবায়নের মাটিতে নামানোর। আইনকে কাগজে নয়-বাস্তবে প্রমাণ করার।

গতি-সীমা চিহ্নকে কেবল বোর্ড নয়, অভ্যাস ও সংস্কৃতি বানানোর। নইলে বাংলাদেশের হাইওয়ে থাকবে আগের মতোই- ‘মৃত্যুর হাইওয়ে।’

বিকেপি/এনএ

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

আইন ও আদালত আইনি প্রশ্ন ও উত্তর

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর