Logo

আইন ও বিচার

ত্যাজ্যের মায়াজাল

উত্তরাধিকারের অধিকার কি ব্যক্তিগত রোষে বাতিল করা যায়?

Icon

আইন ও আদালত ডেস্ক

প্রকাশ: ১১ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮:৩৯

উত্তরাধিকারের অধিকার কি ব্যক্তিগত রোষে বাতিল করা যায়?

আমাদের দেশে পারিবারিক সম্পত্তি বণ্টন নিয়ে বিরোধ যেন পুরোনো কোনো ব্যাধি। সময় বদলেছে, সমাজ বদলেছে, কিন্তু সম্পত্তি নিয়ে পারিবারিক মনোমালিন্য, বঞ্চনা ও বিভ্রান্তি আজও সমাজের প্রতিটি স্তরে দৃশ্যমান। এর মধ্যে সবচেয়ে প্রচলিত এবং বিপজ্জনক একটি সামাজিক মিথ হলো-‘বাবা চাইলে সন্তানকে ত্যাজ্য করে দিতে পারেন, সে আর সম্পত্তি পাবে না।’ কথাটি এত বেশি প্রচলিত যে অনেকেই মনে করেন এটি কোনো স্বীকৃত আইনগত সত্য। অথচ বাস্তবতা হলো-মুসলিম আইন বা বাংলাদেশের প্রচলিত আইন-কোথাও এই ‘ত্যাজ্যপুত্র/ত্যাজ্যকন্যা’ ধারণার কোনো বৈধতা নেই। এক কথায় বললে-ত্যাজ্য ঘোষণা একটি সামাজিক শব্দ, আইনি শব্দ নয়।

আইনের চোখে সন্তানের অধিকার অপরিবর্তনীয় :

মুসলিম ব্যক্তিগত আইন যেহেতু বাংলাদেশের মুসলিম নাগরিকদের উত্তরাধিকার বিধান নির্ধারণ করে, তাই সম্পত্তি বণ্টনের ক্ষেত্রে শরীয়াহই মূল ভিত্তি। শরীয়াহ অনুযায়ী, পিতা বা মাতা মৃত্যুবরণ করলে তার সন্তানেরা নিজ নিজ অংশ স্বয়ংক্রিয়ভাবে উত্তরাধিকারী হয়। সেই অংশ ‘উচ্ছেদ’ বা ‘বাতিল’ করার ক্ষমতা মৃত ব্যক্তির নেই।

জীবিত অবস্থায় যতবারই কোনো পিতা বা মাতা কাউকে ‘ত্যাজ্য’ ঘোষণা করুন না কেন- মৃত্যুর পর আইন মেনে উত্তরাধিকার বণ্টন হতেই হবে। এই নীতিকে পাশ কাটানোর সুযোগ নেই। এটি শুধু ধর্মীয় বিধানই নয়; বরং আইনি নিশ্চয়তাও। আদালত ও আইনজ্ঞরা বহুবার বলেছেন- disownment বা ত্যাজ্য ঘোষণা মুসলিম আইনে কার্যকর নয়। অর্থাৎ, কোনো সন্তানকে ত্যাজ্য করা গেলেও তার উত্তরাধিকার কাটা যায় না।

তবুও বঞ্চনা ঘটে কেন? :

আইন স্পষ্ট হলেও বাস্তবতা প্রায়ই উল্টো। সমাজে বারবার দেখা যায় সন্তান বা বিশেষ করে কন্যারা সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হয়। এর কারণ আইনের জটিলতা নয়; বরং সামাজিক অজ্ঞতা, ভয়ভীতি, পারিবারিক চাপ এবং ভুল ধারণার দৌরাত্ম্য। কিছু মানুষ মনে করেন, সন্তান যদি কথা না শুনে, অযোগ্য হয়, কিংবা পারিবারিক অমিল থাকে-তাহলে তাকে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করা ন্যায্য। কিন্তু ধর্মীয় বিধান বা আইন-কোথাও এ ধরনের কোনো ব্যতিক্রম নেই। 

যেটুকু ব্যতিক্রম আছে, তা খুবই সীমিত- যেমন: সন্তান ইচ্ছাকৃতভাবে পিতা বা মাকে হত্যা করলে, সন্তান ধর্মত্যাগ করলে, বা বৈধ সন্তানের মর্যাদা না থাকলে- তবেই সে উত্তরাধিকার হারাতে পারে। এই ব্যতিক্রমগুলো অত্যন্ত সংকীর্ণ এবং বিশেষায়িত। এর বাইরে ব্যক্তিগত রোষ, অভিমান, ক্ষোভ-কোনো কারণেই উত্তরাধিকার বাতিল করা যায় না।

হেবা, দান ও উইলের ভুল ব্যাখ্যা :

বাংলাদেশের সমাজে উত্তরাধিকার বঞ্চনার অন্যতম বড় ফাঁদ হলো- জীবিত অবস্থায় হেবা বা দান। পিতা জীবদ্দশায় চাইলে নিজের সম্পত্তি যেকোনো সন্তানকে দিতে পারেন, এবং এতে আইন বাধা দেয় না। কিন্তু মানুষ ভুলে যায়, এই ‘হেবা’ মূলত জীবিত অবস্থার লেনদেন। একে ভিত্তি করে মৃত্যুর পর অন্য সন্তানের অধিকার কেটে দেয়া যায় না। অধিকন্তু, হেবা বৈধ হতে হলে নির্দিষ্ট আইনি প্রক্রিয়া-দখল হস্তান্তর ও রেজিস্ট্রেশন-অনুসরণ করতে হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই প্রক্রিয়া অসম্পূর্ণ থাকে, অথবা পরিবারের চাপ দিয়ে দলিলে স্বাক্ষর নেওয়া হয়।

ফলে মৃত্যুর পর প্রকৃত উত্তরাধিকারীরা আইনি জটিলতায় পড়ে। উইলের ক্ষেত্রেও মানুষের ভুল ধারণা অগণিত। অনেকেই মনে করেন তারা মৃত্যুর আগে পুরো সম্পত্তিই যাকে খুশি দিয়ে যেতে পারবেন। কিন্তু ইসলামি ও প্রচলিত আইনে উইলের সীমা- মোট সম্পত্তির মাত্র এক-তৃতীয়াংশ। বাকি দুই-তৃতীয়াংশ উত্তরাধিকারীদের নির্ধারিত অংশ অনুসারেই বণ্টন করতে হয়। অর্থাৎ, উইল ও হেবা-সন্তান বঞ্চনার অস্ত্র নয়; বরং এগুলো ভুলভাবে ব্যবহৃত হলে পারিবারিক বিপর্যয় ডেকে আনে।

দত্তক সন্তান: আবেগ আছে, অধিকার নেই :

বাংলাদেশে দত্তক সন্তানের আইনি অবস্থানও বিভ্রান্তিকর। অনেকেই মনে করেন দত্তক নিলে সে প্রকৃত সন্তানের মতো সম্পত্তি পাবে। কিন্তু মুসলিম আইনে দত্তক সন্তানের উত্তরাধিকার নেই। তার ভবিষ্যৎ সুরক্ষা দিতে চাইলে জীবদ্দশায় নিবন্ধিত হেবা বা বৈধ উইলই একমাত্র পথ। কিন্তু সমাজে অধিকাংশ মানুষ এটি জানেন না, ফলে মৃত্যুর পর দত্তক সন্তান আইনি সুরক্ষা হারায়। এটিও একটি স্পষ্ট উদাহরণ-আইন না জানার কারণে যাদের বঞ্চিত হওয়ার কথা নয়, তারাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন।

নারী উত্তরাধিকারীদের বাস্তবতা আরও কঠিন :

বাংলাদেশে সম্পত্তি বণ্টনে সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত হয় কন্যারা। যদিও শরীয়াহ কন্যাকে নির্ধারিত অংশ দিয়েছে- তিনি পিতার মৃত্যুর পর সেই অংশ পাওয়ার যোগ্য, এবং আইন তা নিশ্চয়তা দেয়। তবু পারিবারিক চাপ, অজ্ঞতা, ভাইদের ‘মান-সম্মান’ কথিত যুক্তি, অথবা পুরোনো সামাজিক রীতিনীতির কারণে মেয়েদের অংশ দেওয়া হয় না। অনেক ক্ষেত্রে কন্যাকে বলা হয়-‘তোমাকে তো বিয়েতে সব দেওয়া হয়েছে।’

এটি কেবল একটি সামাজিক অবিচার নয়; এটি আইন লঙ্ঘনও। কন্যা চাইলে আইনগতভাবে তার অংশ দাবি করতে পারেন-partition suit করে। কিন্তু নারীদের বড় অংশ এই অধিকার সম্পর্কে জানেন না, বা আর্থিক ও সামাজিক চাপে দাবি করতে পারেন না।

সামাজিক মিথ ও আইনি সত্যের সংঘর্ষ :

এখানেই প্রশ্ন- এই ভুল ধারণাগুলো টিকে থাকে কীভাবে? প্রথমত, আইন সম্পর্কে সাধারণ মানুষের অজ্ঞতা ভয়াবহ। দ্বিতীয়ত, পরিবার ও সমাজে গুজব-নির্ভর ব্যাখ্যা প্রজন্ম ধরে চলে আসছে। তৃতীয়ত, অনেকেই মনে করেন শরীয়াহ শুধু পুরুষের পক্ষে, অথচ শরীয়াহ-ই কন্যাকে অংশ দিয়েছে। চতুর্থত, ‘ত্যাজ্যের’ ভয় দেখিয়ে অনেক পরিবারে মানসিক চাপ সৃষ্টি করা হয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো- আইন, ধর্ম, ও ন্যায়- তিনটিই সন্তানের অধিকারকে সুরক্ষা দেয়।

ব্যক্তিগত ক্ষোভ, অভিমান, বা পারিবারিক বিরোধ কোনোভাবেই উত্তরাধিকার বাতিল করতে পারে না। সামাজিক বিভ্রান্তি দূর করতে হলে জরুরি কয়েকটি পদক্ষেপ প্রয়োজন- 

জনসচেতনতা বৃদ্ধি:

স্কুল, কলেজ, সামাজিক সংগঠন ও গণমাধ্যমে উত্তরাধিকার আইন সম্পর্কে প্রচারণা জরুরি। নারীর অধিকার নিয়ে বিশেষ ক্যাম্পেইন। কন্যারা জানুক, তারা পিতার সম্পত্তিতে বৈধ অংশীদার- এটি শুধু ধর্মীয় নির্দেশই নয়, আইনি অধিকারও।

হেবা-দান-উইলের সঠিক প্রক্রিয়া মানা:

নিবন্ধন ছাড়া দলিলের কোনো মূল্য নেই। ভুল দলিল পরিবারের ভবিষ্যৎ ধ্বংস করে।

আইনি সহায়তা সহজলভ্য করা:

উত্তরাধিকার বঞ্চনার মামলা করা কঠিন নয়, ব্যয়সাধ্যও নয়। মানুষকে এটি জানাতে হবে।পরিবারে আলোচনার সংস্কৃতি গড়ে তোলা; গোপনে সম্পত্তি হস্তান্তর নয়; পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে খোলাখুলি আলোচনা প্রয়োজন। 

বাংলাদেশে উত্তরাধিকার বিভ্রান্তির মূল শিকড়-আইন নয়, বরং মানুষের ভুল ধারণা। ত্যাজ্যপুত্র-ত্যাজ্যকন্যা কোনো আইনগত শব্দ নয়; এটি কেবল সামাজিক কল্পনা। কিন্তু এই কল্পনার কারণে বাস্তব জীবন ভেঙে যায়, পরিবার বিচ্ছিন্ন হয়, আর অধিকার হারায় নির্দোষ মানুষ।

আমাদের মনে রাখতে হবে- উত্তরাধিকার কোনো অনুগ্রহ নয়, এটি জন্মগত অধিকার। এই অধিকার ক্ষোভে, রোষে, কিংবা ‘ত্যাজ্য’ ঘোষণা করে বাতিল করা যায় না। যে সমাজ আইনের চেয়ে আবেগকে বেশি মূল্য দেয়, সেই সমাজেই বঞ্চনা বাড়ে- আর ন্যায় হারিয়ে যায়। সচেতনতা ও ন্যায়ের সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই এটাই বদলানো সম্ভব। এখন সময় আইনকে জানার, মানার এবং সঠিক উত্তরাধিকার নিশ্চিত করার।

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

আইন ও আদালত আইনি প্রশ্ন ও উত্তর

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর