সৎ সন্তানকে সম্পত্তি দান : আইনি স্বাধীনতার সঙ্গে সামাজিক বাস্তবতার সংঘাত
আইন ও আদালত ডেস্ক
প্রকাশ: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১:০১
দেশের পারিবারিক কাঠামো যেমন পরিবর্তিত হচ্ছে, তেমনি পরিবর্তিত হচ্ছে সম্পত্তি বণ্টন নিয়ে মানুষের ভাবনা। পুনর্বিবাহ, সৎ সন্তান, মিশ্র পরিবার - এই নতুন বাস্তবতাগুলো আমাদের সামাজিক ও আইনি ব্যবস্থাকে নতুন নতুন প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করাচ্ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত একটি প্রশ্ন হলো, সৎ ছেলে বা সৎ মেয়েকে কি পুরো সম্পত্তি দান করা যায়? আইন এ বিষয়ে কী বলছে এবং সমাজ কীভাবে তা গ্রহণ করছে- এই দুইয়ের দ্ব›দ্বই আজকের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু।
বাংলাদেশের দান আইন (হেবা), সিভিল আইন এবং ধর্মীয় পারিবারিক আইন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, জীবদ্দশায় যে কোনো ব্যক্তি তার সম্পত্তি যাকে ইচ্ছা তাকে দান করতে পুরোপুরি স্বাধীন। আইন কখনো জিজ্ঞাসা করে না- গ্রহীতা সন্তান কি জৈব, দত্তক, নাকি সৎ সন্তান। আইনের দৃষ্টিতে গ্রহীতা শুধু একজন বৈধ ব্যক্তি; সৎ সন্তান হওয়া তার কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে না। এ অর্থে, সৎ ছেলে বা সৎ মেয়েকে সম্পত্তি দান ১০০ শতাংশ বৈধ ও গ্রহণযোগ্য। এমনকি চাইলে পুরো সম্পত্তি দান করাও বাধাহীন। অথচ এখানেই তৈরি হয় সামাজিক উত্তাপ। বাংলাদেশি সমাজে “রক্তের সম্পর্ক” একটি অত্যন্ত শক্তিশালী আবেগ। ফলে জৈব সন্তানরা অনেক সময় মনে করেন-সৎ সন্তানকে সম্পত্তি দেওয়া মানে তাদের অধিকার ক্ষুণ্ন করা। আবার স্ত্রী বা স্বামীও দাবি তুলতে পারেন যে এই দানটি অন্যায় কিংবা প্ররোচনা বা প্রতারণার ফল। এ থেকেই শুরু হয় পারিবারিক অস্থিরতা, যা অনেক সময় আদালত পর্যন্ত গড়ায়।
উত্তরাধিকার আইনে সৎ সন্তান বঞ্চিত- এটাই মূল দ্বন্দ্বের কারণ। বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে সৎ সন্তান উত্তরাধিকারী হিসেবে গণ্য হয় না। তাই মৃত্যুর পর সম্পত্তি বণ্টনে তারা স্বয়ংক্রিয়ভাবে অংশ পায় না। সৎ সন্তানকে সম্পত্তি দিতে চাইলে তা অবশ্যই জীবিত অবস্থায় দান করতে হবে। এই বাস্তবতার কারণে অনেকেই সৎ সন্তানকে নিরাপদ রাখতে দানপত্র তৈরি করেন। কিন্তু তখনই পরিবারে প্রশ্ন ওঠে- “জৈব সন্তানের তো অধিকার আছে, তাহলে পুরো সম্পত্তি সৎ সন্তানকে কেন?” এ প্রশ্ন থেকেই আমরা বুঝতে পারি, আইন স্বাধীনতা দিলেও সমাজ তা সহজভাবে নিতে প্রস্তুত নয়।
মুসলিম আইনে দানের স্বাধীনতা : সুবিধা না অসুবিধা? : মুসলিম আইন অনুযায়ী হিবা বা দান একটি অত্যন্ত স্বাধীন প্রক্রিয়া। এখানে দানে কোনো সীমা নেই। জীবদ্দশায় চাইলে ১০০ শতাংশ সম্পত্তি দান করা যায়। গ্রহীতা জৈব সন্তান না হলেও সমস্যা নেই। দান কার্যকর করতে চাইলে দখল হস্তান্তর বাধ্যতামূলক তবে একটি জটিলতা এখানে দেখা দেয়। আইন দানকারীর মানসিক সক্ষমতা, ইচ্ছা, স্বাধীনতা- এসব বিষয়কে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়। ফলে যদি জৈব সন্তান বা স্ত্রী দাবি করেন যে দানটি জোর করে নেওয়া হয়েছে, বা দানকারীর মানসিক অবস্থা দুর্বল ছিল, তখন পুরো দানপত্র আদালতে চ্যালেঞ্জ হতে পারে। এর ফলে বহু বছর ধরে মামলা চলার ঘটনাও কম নয়।
হিন্দু ও খ্রিস্টান আইনে পরিস্থিতি :
হিন্দু বা খ্রিস্টান আইনের ক্ষেত্রেও জীবদ্দশায় দান করার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা আছে। হিন্দু আইনে যৌথ সম্পত্তি ব্যতীত ব্যক্তিগত সম্পত্তি যেকেউ যাকে ইচ্ছা দান করতে পারেন। খ্রিস্টান আইনে আরও সহজ, দানে কোনো বাধা নেই, সৎ সন্তানও বৈধ গ্রহীতা। আইন যতই উদার হোক না কেন, সমাজে সৎ সন্তানকে দান করা বিষয়টি অনেক সময় “সংবেদনশীল সিদ্ধান্ত” হিসেবে দেখা হয়, কারণ এতে পরিবার বিভক্তির সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে- ব্যক্তির নিজের সম্পত্তির মালিকানা তার নিজের, তাহলে তিনি ইচ্ছা প্রকাশ করলেই আপত্তি কেন?
সামাজিক প্রতিক্রিয়া : আইন মানে, কিন্তু মন মানে না :
বাংলাদেশের পারিবারিক বাস্তবতা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়- রক্তের সম্পর্ককে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়, সৎ সন্তান সম্পর্কে গভীর মানসিক ফাঁক দীর্ঘদিন থেকেই আছে, সম্পত্তি বণ্টনকে ঘিরে পরিবারে সন্দেহ, ঈর্ষা ও প্রতিযোগিতা তৈরি হয়, বিশেষ করে ছেলেদের মধ্যে সম্পত্তি-কেন্দ্রিক বিরোধ বেশি দেখা যায়। সৎ সন্তানকে দান করলে প্রায়ই “অন্যায়” হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়। অথচ একই সমাজ সম্পত্তির মালিকানা ও ইচ্ছার স্বাধীনতাকে মূল্য দেয় না। ফলে আইন ও সামাজিক মানদণ্ড- দুটির মধ্যে স্পষ্ট দ্ব›দ্ব তৈরি হয়।
দান করতে চাইলে কী কী বিষয় বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে- প্রথমত রেজিস্ট্রি করা দাননামা, মৌখিক দান বা হাতে লেখা কাগজের দানপত্র সহজেই চ্যালেঞ্জ হতে পারে। রেজিস্ট্রি করা দাননামা সর্বাধিক নিরাপদ। দ্বিতীয়ত- গ্রহীতার গ্রহণ, ডকুমেন্টে গ্রহণের স্বাক্ষর থাকতে হবে। তৃতীয়ত- দখল হস্তান্তর। এটি না হলে দান কার্যকর হবে না। চতুর্থত- সাক্ষী, দুইজন নিরপেক্ষ সাক্ষী থাকলে ভবিষ্যতের জটিলতা কমে। স্ট্যাম্প, রেজিস্ট্রি ও দখল ছাড়াও নামজারি দানের নিরাপত্তা বহুগুণ বাড়ায়। যদিও বাধ্যতামূলক নয়, কিন্তু ভবিষ্যতে বিরোধ এড়াতে এটি অত্যন্ত কার্যকর। একজন অভিভাবক যদি সৎ সন্তানকে নিজের সন্তানের মতো লালন-পালন করেন, স্নেহ দিয়ে বড় করেন, নিরাপত্তা দেন তাহলে সম্পত্তিও তাঁকে দিতে চাইতে পারেন, এটি সম্পূর্ণ মানবিক। আইনও সেই মানবিকতার পাশেই দাঁড়ায়।
কিন্তু সমাজ প্রায়ই বলে- “নিজের সন্তান থাকা অবস্থায় সৎ সন্তানকে কেন?” এ প্রশ্নটি মূলত নৈতিকতার; কিন্তু সম্পত্তির মালিকানা আইনি অধিকার। আইন ব্যক্তিকে তার স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ দেয়, কারণ সম্পত্তি তার উপার্জিত, তারই মালিকানা। নৈতিকতার পরিমাপক ব্যক্তি নিজেই নির্ধারণ করবেন। সৎ ছেলে বা সৎ মেয়েকে সম্পত্তি দান করা আইনগতভাবে ১০০ শতাংশ বৈধ- এতে কোনো দ্বিধা নেই। তবে পারিবারিক উত্তাপ ও সামাজিক ধারণা প্রায়ই এই আইনি স্বাধীনতাকে চ্যালেঞ্জ করে। ফলে দানকারীর প্রয়োজনে আইনগত নিরাপত্তার পাশাপাশি সামাজিক বাস্তবতাও মাথায় রাখা জরুরি।
আজকের বাংলাদেশে দান, উত্তরাধিকার ও পরিবার- এই তিনটি বিষয়ের সমন্বয় এমনই একটি সংবেদনশীল ক্ষেত্র, যা অনেক সময় আইনি নিয়ম নয়, বরং সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির উপর নির্ভর করে। তবুও আইনের মূল অবস্থান একটাই যার সম্পত্তি, সিদ্ধান্তও তার।
সৎ সন্তানকে সম্পত্তি দেয়া মানবিক সিদ্ধান্ত হলে, আইনের পক্ষ থেকেও এর পূর্ণ স্বাধীনতা ও সুরক্ষা রয়েছে। সমাজকে এখন এই স্বাধীনতার মূল্য উপলব্ধি করতে হবে, যাতে পরিবারে অযথা ভাঙন, অবিশ্বাস ও জটিলতা সৃষ্টি না হয়।
বিকেপি/এমবি

