বাংলাদেশ বিচার বিভাগ সচিবালয় না হয়ে ‘সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়’ নামকরণ
-একটি পর্যালোচনা
অ্যাডভোকেট কাজী মোস্তাফিজুর রহমান আহাদ
প্রকাশ: ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০:১০
সম্প্রতি বাংলাদেশে বিচার বিভাগের দীর্ঘদিনের কাক্সিক্ষত সংস্কারের অংশ হিসেবে একটি স্বতন্ত্র সচিবালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানটির নামকরণ করা হয়েছে ‘সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়’। সাধারণ দৃষ্টিতে বা আবেগের জায়গা থেকে মনে হতে পারে ‘বিচার বিভাগ সচিবালয়’ নামটি হয়তো বেশি সর্বজনীন হতো। তবে এই নামকরণের পেছনে রয়েছে গভীর সাংবিধানিক যুক্তি, আইনি কৌশল এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রশ্ন। কেন এই নামকরণ, দুটির মধ্যে পার্থক্য কী এবং কোন নামটি অধিক যৌক্তিক?
‘সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়’ নামকরণের নেপথ্য কারণ ; এই নামকরণের প্রধান কারণটি মূলত সাংবিধানিক ও প্রশাসনিক কর্তৃত্বের বিষয়টি পরিষ্কার করা। প্রথমত, বাংলাদেশের সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, অধস্তন (নিম্ন) সকল আদালত ও ট্রাইব্যুনালের ওপর হাইকোর্ট বিভাগের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা রয়েছে। এতদিন আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অধস্তন আদালতের বিচারকদের নিয়োগ, বদলি ও শৃঙ্খলা বিষয়ক কাজগুলো হতো বলে বিচার বিভাগের ওপর এক ধরণের ‘দ্বৈত শাসন’ বজায় ছিল। এখন যেহেতু এই ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্ট সরাসরি প্রয়োগ করবে, তাই এই প্রশাসনিক কর্মযজ্ঞ পরিচালনার জন্য যে সচিবালয়টি কাজ করবে, তা গঠনগতভাবে সুপ্রিম কোর্টেরই অংশ হওয়া বাঞ্ছনীয়।
দ্বিতীয়ত, যদি এর নাম ‘বিচার বিভাগ সচিবালয়’ রাখা হতো, তবে প্রশাসনিকভাবে একটি ধোঁয়াশা তৈরির সুযোগ থাকত। এটি কি আইন মন্ত্রণালয়ের অধীনে কোনো বিশেষ উইং? নাকি সম্পূর্ণ স্বাধীন কোনো কমিশন? ‘সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়’ নামটি এই বিভ্রান্তি দূর করে নিশ্চিত করে যে, এই সচিবালয়টি সরাসরি মাননীয় প্রধান বিচারপতির অধীন এবং সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের দপ্তরের একটি বর্ধিত ও শক্তিশালী প্রশাসনিক রূপ।
‘বিচার বিভাগ সচিবালয়’ ও ‘সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়’-এর মধ্যে পার্থক্য
যদিও উভয় নামের মূল উদ্দেশ্য বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, তবু এদের ধারণা ও প্রায়োগিক অর্থের মধ্যে সূ² পার্থক্য রয়েছে:
ধারণাগত পার্থক্য : ‘বিচার বিভাগ সচিবালয়’ একটি ব্যাপক ধারণা, যা বিচার বিভাগের প্রশাসনিক কাজের জন্য স্বতন্ত্র একটি দপ্তরকে বোঝায়। অন্যদিকে, ‘সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়’ একটি সুনির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠান যা সুপ্রিম কোর্টের প্রশাসনিক কাঠামোর অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে কাজ করে।
নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ব : ‘বিচার বিভাগ সচিবালয়’ নাম হলে ভবিষ্যতে নির্বাহী বিভাগ বা মন্ত্রণালয়ের পরোক্ষ প্রভাব বিস্তারের একটি সুযোগ থেকে যেতে পারে। কিন্তু ‘সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়’ হলে এর নিয়ন্ত্রণ শতভাগ সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল এবং প্রধান বিচারপতির হাতে থাকে, যেখানে বাইরের হস্তক্ষেপের সুযোগ কম।
সাংবিধানিক অবস্থান : সংবিধানে অধস্তন আদালতের ওপর সুপ্রিম কোর্টের কর্তৃত্বের কথা বলা হয়েছে। তাই সচিবালয়টি সুপ্রিম কোর্টের নামে হওয়াই সাংবিধানিক কাঠামোর সাথে বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ।
স্বাধীন বিচার বিভাগের জন্য ‘বিচার বিভাগ সচিবালয়’ নামটি কি উচিত ছিল?
এটি একটি তাত্ত্বিক বিতর্কের বিষয়। ‘বিচার বিভাগ সচিবালয়’ নামটি শুনলে মনে হয় এটি সমগ্র বিচার অঙ্গনের (উচ্চ আদালত ও নিম্ন আদালত) একটি সমন্বিত ও সাধারণ প্রতিষ্ঠান। অধস্তন আদালতের বিচারকদের অনেকের আবেগের জায়গা থেকে ‘বিচার বিভাগ সচিবালয়’ নামটি বেশি গ্রহণযোগ্য মনে হতে পারে, কারণ এতে তাদের নিজেদের ‘বিচার বিভাগের অংশ’ হিসেবে ভাবা সহজ হয়, সুপ্রিম কোর্টের প্রশাসনিক অধীনস্ত হিসেবে নয়।
তবে আইনি ও বাস্তবিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায়, ‘সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়’ নামটি অধিকতর শক্তিশালী ও যুক্তিযুক্ত। এর পেছনে প্রধান দুটি যুক্তি হলো:
আইনি সুরক্ষা: বিচার বিভাগের স্বাধীনতা মানেই হলো নির্বাহী বিভাগ (মন্ত্রণালয়) থেকে আলাদা হওয়া। ‘সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়’ নাম হলে নির্বাহী বিভাগ চাইলেও ভবিষ্যতে এই সচিবালয়ের ওপর কর্তৃত্ব দাবি করতে পারবে না, কারণ এটি সুপ্রিম কোর্টের নিজস্ব অঙ্গ।
চেইন অব কমান্ড রক্ষা: বিচার বিভাগে চেইন অব কমান্ড বা হাইকোর্টের তত্ত্বাবধান অত্যন্ত জরুরি। একটি পৃথক ‘বিচার বিভাগ সচিবালয়’ হলে ভবিষ্যতে সেটি সুপ্রিম কোর্টের সমান্তরাল বা প্যারালাল কোনো শক্তিকেন্দ্র হয়ে ওঠার ঝুঁকি থাকত, যা বিচার প্রশাসনের শৃঙ্খলার জন্য ক্ষতিকর হতে পারত। সুপ্রিম কোর্টের অধীনে রাখলে সেই ঝুঁকি থাকে না।
পরিশেষে বলা যায়, যদিও ‘বিচার বিভাগ সচিবালয়’ নামটি শ্রুতিমধুর এবং সর্বজনীন মনে হয়, কিন্তু মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পূর্ণ বাস্তবায়ন এবং বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে ‘সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়’ নামটিই অধিকতর বাস্তবসম্মত। এটি নিশ্চিত করে যে, বিচার বিভাগের প্রশাসনিক নাটাই এখন থেকে আর মন্ত্রণালয়ের হাতে নয়, বরং সরাসরি দেশের সর্বোচ্চ আদালতের হাতেই থাকবে, যা সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদের চেতনার সাথে পুরোপুরি সঙ্গতিপূর্ণ।
সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় প্রতিষ্ঠা বর্তমান সরকার, মাননীয় প্রধান বিচারপতি এবং মাননীয় অ্যাটর্নি জেনারেলের সম্মিলিত প্রচেষ্টার এক ঐতিহাসিক সাফল্য।
লেখক : অ্যাডভোকেট কাজী মোস্তাফিজুর রহমান আহাদ, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
বিকেপি/এমবি

