দেশে অজ্ঞাত বা পরিচয়হীন লাশ (বা স্বজনের না-দাবিপ্রাপ্ত লাশ) অন্যতম সামাজিক ও মানবিক চ্যালেঞ্জ। যদিও সামান্য প্রচলিত উদ্যোগ ও সংস্থা আছে, কিন্তু আইনগত ফ্রেমওয়ার্ক, ইমপ্লিমেন্টেশন, এবং সামাজিক দায়বদ্ধতা এখনও স্পষ্ট নয়।
আঞ্জুমান মফিদুল ইসলাম এর মতো স্বেচ্ছাসেবা প্রতিষ্ঠান নিয়মিত “বেওয়ারিশ” হিসেবে পাওয়া মরদেহ সংগ্রহ ও দাফন করে থাকে। ২০২৫ সালের তথ্য অনুযায়ী, এক বছরে দেশে কয়েকশ’ এমন লাশ এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দাফন করা হয়েছে। এমন উদ্যোগ না থাকলে অভাবনীয় সংখ্যক লাশ হয়তো হাসপাতাল মর্গ বা রাস্তার পাশে রাত দিন পড়ে থাকতো।
এখনও বাংলাদেশে এমন কোনো নির্দিষ্ট আইন বা আইনগত প্রক্রিয়া নেই, যা মৃতদেহ, বিশেষ করে বেওয়ারিশ লাশ, সুরক্ষিত দাফনের নিশ্চয়তা দিচ্ছে- না কারো কবর চুরি-কঙ্কাল চুরির প্রতিরোধ, না কবর চিহ্নিতকরণ, না ডিএনএ বা পরিচয় শনাক্তকরণের ন্যূনতম গ্যারান্টি। বাস্তবে, কবরস্থানে অনেক বেওয়ারিশ কবর চিহ্নহীন, নম্বর বা নামফলক নেই। কবরগুলোর কোনটিতে কারা শায়িত, সেটা কোনো রেকর্ড নেই বলে স্বজনরা পরে খুঁজে পায় না।
কিছু ক্ষেত্রে, এমন দাফন হয়েছে যারা ‘গণ-অভ্যুত্থানে’ নিহত কিন্তু পরিচয়হীন হওয়ায় “বেওয়ারিশ” হিসেবে দাফন করা হয়েছে। ফলে পরে অনেক পরিবার দাবি করলেও, কোন কবর তাদের প্রিয়জনের, সেটা নিশ্চিত করা যায় না। একই সাথে, সম্প্রতি কবরের সুরক্ষার প্রায়ই লুণ্ঠন, কঙ্কাল চুরি- বিক্রি, এমন ন্যক্কারজনক ঘটনা প্রকাশ পেয়েছে। ঐঈ-র নির্দেশের পরেও আইনগত ব্যবস্থা না থাকায় এ ধরনের অপরাধ বন্ধ হয়নি।
আমরা সামাজিকভাবে, ধর্মীয় বা নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে মৃত মানুষকে মর্যাদা দিতে চাই। এটি শুধু ব্যক্তিগত নয়- সামাজিক ও মানবিক মর্যাদা। কিন্তু বাস্তবে, অনেক অজ্ঞাত মানুষের মরদেহ “বেওয়ারিশ” হিসেবে পাশাপাশির ভরিতে নিয়ে গেছে কেউ না কিছু জানে। এ ধরনের দাফন যদি ফ্রেম-লেস হয়, তাহলে মৃত ব্যক্তির পরিচয় কখনো উদ্ধার সম্ভব হয় না- ফলে তাদের পরিবারের ইচ্ছা, দাবী, বিচার (যদি হত্যাকাণ্ড সম্পর্কিত) প্রায় অসম্ভব হয়। কবর চুরি, কঙ্কাল বিক্রি ইত্যাদির মতো সামাজিক অপরাধের সুযোগ বাড়ে। ভবিষ্যতে, নজরদারি, পুনরায় আবোল-তাবোল বা পুনরাবৃত্তির (ৎব-নঁৎরধষ) সম্ভবনা ধরে রাখা কঠিন হয়ে যায়। এ কারণে, একটি সমন্বিত, আইনগত ফ্রেমওয়ার্ক প্রয়োজন যা- অজ্ঞাত / বেওয়ারিশ মৃতদেহের জন্য সুনির্দিষ্ট নিয়ম রাখবে: শনাক্তকরণ (যেমন- ডিএনএ, ছবি, থানা রিপোর্ট), কবর চিহ্নিতকরণ, নিবন্ধন। কবরস্থানের সুরক্ষা বিধান থাকবে; কবর খনন বা কঙ্কাল চুরি বিরোধী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা থাকবে। দাফন করার পরে সংশ্লিষ্ট তথ্য (তারিখ, কবর নম্বর, মৃতদেহের শেষ চিহ্ন, সম্ভব হলে অভিভাবক / সংস্থা) রেকর্ড থাকবে, যাতে ভবিষ্যতে স্বজনেরা দাবি করতে পারে। রাষ্ট্র বা স্থানীয় প্রশাসনের দায়িত্ব থাকবে- সামাজিক দায়বদ্ধতা ও মর্যাদা রক্ষা।
মৃত হওয়া মানে সবকিছু শেষ নয়। একজন মানুষের জীবন শেষ হলেও, তার মর্যাদা, তার মধ্যে থাকা পরিচয়, তার স্মৃতি- তা রক্ষা করা সামাজিক দায়বদ্ধতা। বেওয়ারিশ লাশ শুধু “কেউ না-দাবিপ্রাপ্ত” মরদেহ নয়; তারা হতে পারে কারো ছেলে, বোন, অভিভাবক, বা জীবনের যাত্রাপথ হারানো এক মনুষ্য।
এখনই সময়- আইন, প্রশাসন এবং সমাজ একত্রে কাজ করার; বেওয়ারিশ লাশ দাফনের বিষয়ে স্পষ্ট, মানবিক, দায়িত্বশীল পন্থা গড়ে তোলার।
বিকেপি/এমবি

