বাংলাদেশে প্রতিবছর মহান বিজয় দিবস (১৬ ডিসেম্বর) উপলক্ষে কারা অধিদফতর বিভিন্ন জেলা কারাগারে লঘু অপরাধে দণ্ডিত কিছু বন্দির অবশিষ্ট সাজা মওকুফ করে মুক্তি দেয়। এ ধরনের খবর প্রায়ই কারা অধিদফতরের বার্ষিক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে প্রকাশিত হয়। কখনো ৩–৪ জন, কখনো আরও বেশি বন্দি উৎসবকে কেন্দ্র করে পরিবারের কাছে ফিরে যাওয়ার সুযোগ পান।
কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—কোন আইনে এই সাজা মওকুফ হয়? কে আদেশ দেন? কোন ধরনের অপরাধীরা মুক্তির সুযোগ পান? এবং এই প্রক্রিয়া কতটা স্বচ্ছ?
রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শনের ক্ষমতা: সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদ
বাংলাদেশের সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতি যেকোনো আদালত বা ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক প্রদত্ত দণ্ড ক্ষমা, স্থগিত, বিরাম, হ্রাস বা মওকুফ করতে পারেন। এটি রাষ্ট্রপতির অন্যতম বিশেষ সাংবিধানিক ক্ষমতা।
সংবিধানের ভাষায়, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা রয়েছে ‘ক্ষমা প্রদর্শন, স্থগিত, বিরাম বা হ্রাস করা কিংবা দণ্ড পরিবর্তন করার।’ অর্থাৎ কারো সাজা কমিয়ে দেওয়া, অবশিষ্ট অংশ বাতিল করা বা বিশেষ পরিস্থিতিতে পুরো সাজাই ক্ষমা করা রাষ্ট্রপতির এখতিয়ারভুক্ত।
তবে রাষ্ট্রপতি এ ক্ষমতা স্বতঃপ্রণোদিতভাবে প্রয়োগ করেন না। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং কারা অধিদফতরের মাধ্যমে প্রাপ্ত সুপারিশ পর্যালোচনা করেই তিনি সিদ্ধান্ত নেন। সাধারণত প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী এই সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়। কারা কর্তৃপক্ষের এককভাবে সাজা মওকুফের কোনো ক্ষমতা নেই; চূড়ান্ত অনুমোদন রাষ্ট্রপতিরই।
বিজয় দিবসে কেন সাজা মওকুফ করা হয়
বিজয় দিবস বাংলাদেশের জাতীয় জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ দিন। মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা ও মানবিক মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এদিন প্রচলিত রীতি অনুযায়ী লঘু অপরাধে দণ্ডিত, ভালো আচরণ প্রদর্শনকারী এবং সাজার বড় অংশ ভোগ করা বন্দিদের অবশিষ্ট সাজা মওকুফ করে মুক্তি দেওয়া হয়।
এটি সম্পূর্ণভাবে আইনি ক্ষমার কাঠামোর মধ্যে হলেও এর উদ্দেশ্য মানবিক। জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় উৎসবে বিশ্বের অনেক দেশেই এমন মানবিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বাংলাদেশও সেই ধারাবাহিকতায় নিজস্ব একটি প্রথা গড়ে তুলেছে।
কে মুক্তি পান, কোন ধরনের অপরাধে
কারা অধিদফতর ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সাধারণত যেসব বন্দিকে মুক্তির জন্য প্রস্তাব করে, তারা হলো—
লঘু অপরাধে দণ্ডিত বন্দি, যেমন সীমিত মাত্রার চুরি, সামান্য মারামারি, ছোটখাটো আইন লঙ্ঘন, আর্থিক জরিমানা সংক্রান্ত মামলা বা স্বল্প মেয়াদের কারাদণ্ডপ্রাপ্তরা।
যাদের সাজার ৫০ শতাংশ বা তার বেশি অংশ ভোগ করা হয়েছে, তাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। কারণ সাজাভোগের বড় অংশ শেষ হলে বন্দি সংশোধনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ অতিক্রম করেছে বলে ধরা হয়, যা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডেও স্বীকৃত।
কারাবিধি মেনে চলা ও ভালো আচরণ
কারা কর্তৃপক্ষের প্রতিবেদনে বন্দির আচরণ ভালো হওয়া একটি মৌলিক শর্ত। পাশাপাশি বয়স, দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতা, পারিবারিক সংকটসহ বিশেষ মানবিক দিকগুলোও বিবেচনায় নেওয়া হয়।
কে মুক্তি পান না
হত্যা, ধর্ষণ, সন্ত্রাসবাদ, রাষ্ট্রদ্রোহ, বড় পরিসরের মাদক কারবারসহ গুরুতর অপরাধে দণ্ডিতরা সাধারণত কোনো জাতীয় উৎসবেই সাজা মওকুফের সুযোগ পান না।
কারা অধিদফতরের প্রক্রিয়া যেভাবে চলে
প্রক্রিয়াটি সাধারণত কয়েকটি ধাপে সম্পন্ন হয়— প্রথমে দেশের সব কারাগার থেকে বন্দিদের আচরণ, অপরাধের ধরন ও সাজাভোগের অগ্রগতি পর্যালোচনা করে একটি প্রাথমিক তালিকা প্রস্তুত করা হয়। এরপর কারা অধিদফতর সেই তালিকা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। মন্ত্রণালয়গুলো আইনি ও প্রশাসনিক দিক যাচাই করে অনুমোদনযোগ্য প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রেরণ করে।
প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি সংবিধান অনুযায়ী চূড়ান্ত অনুমোদন দেন। রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পাওয়ার পর কারা কর্তৃপক্ষ মুক্তির আদেশ কার্যকর করে এবং সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বিষয়টি জনসমক্ষে জানানো হয়।
বিকেপি /এনএ