Logo

আইন ও বিচার

আদালতের অনুমতি ছাড়া হেফাজত, আইন কী বলে?

Icon

মাসুম আহম্মেদ

প্রকাশ: ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮:৩৬

আদালতের অনুমতি ছাড়া হেফাজত, আইন কী বলে?

দেশে আজ একটি প্রশ্ন নীরবে কিন্তু গভীরভাবে মানুষের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে- আদালতের অনুমতি ছাড়া পুলিশ বা গোয়েন্দা সংস্থা কি কাউকে বাড়ি, রাস্তা, কর্মস্থল বা বাজার থেকে তুলে নিয়ে যেতে পারে? আর যদি নিয়ে যায়, সেটি কি আইনসম্মত?

বাস্তব অভিজ্ঞতা বলছে, বহু ক্ষেত্রেই পরিবারের সদস্যরা জানেন না কাকে, কোথায়, কেন নেওয়া হয়েছে। মোবাইল ফোন বন্ধ, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন, দিনের পর দিন অজানা হেফাজত- এই বাস্তবতা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সঙ্গে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ?

আইনের শাসন কেবল আদালত ভবনের ভিতরে সীমাবদ্ধ নয়; এটি নাগরিকের দৈনন্দিন নিরাপত্তাবোধের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। একজন মানুষ রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারবেন কি না, সেটিও আইনের শাসনের মানদণ্ড।

বাংলাদেশের সংবিধান খুব স্পষ্টভাবে ব্যক্তি-স্বাধীনতার সুরক্ষা দিয়েছে। সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদ বলছে- আইনের আশ্রয় লাভ করা প্রত্যেক নাগরিকের অধিকার। ৩২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- আইনসম্মত পদ্ধতি ব্যতীত কোনো ব্যক্তিকে জীবন বা ব্যক্তিস্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করা যাবে না।

এই দুটি অনুচ্ছেদ একত্রে পড়লে স্পষ্ট হয়- আইনসম্মত প্রক্রিয়া ছাড়া কাউকে আটক বা হেফাজতে নেওয়া সংবিধানবিরোধী। এখানে ‘আইনসম্মত প্রক্রিয়া’ বলতে বোঝানো হয়েছে আদালতের তত্ত্বাবধান ও ফৌজদারি কার্যবিধি অনুসরণ। পুলিশের ক্ষমতা কোথায় শুরু, কোথায় শেষ: বাংলাদেশে পুলিশি ক্ষমতার মূল ভিত্তি হলো ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮ (সিআরপিসি)।

ধারা ৫৪: পরোয়ানা ছাড়া গ্রেপ্তার। এই ধারায় পুলিশ কিছু নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে পরোয়ানা ছাড়া গ্রেপ্তার করতে পারে। যেমন- আমলযোগ্য অপরাধে জড়িত থাকার যুক্তিসংগত সন্দেহ, অপরাধ সংঘটনের আশঙ্কা, পলায়নের সম্ভাবনা, কিন্তু এখানে একটি বড় ‘কিন্তু’ রয়েছে। এই ক্ষমতা অবারিত নয়। হাইকোর্ট বহুবার বলেছেন- ধারা ৫৪ পুলিশকে ‘জিজ্ঞাসাবাদের জন্য’ কাউকে তুলে নেওয়ার লাইসেন্স দেয় না।

ঐতিহাসিক রায়- BLAST বনাম বাংলাদেশ: ২০০৩ সালে হাইকোর্টের দেওয়া ঐতিহাসিক রায় BLAST বনাম বাংলাদেশ সরকার মামলায় গ্রেপ্তার ও রিমান্ড নিয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেয়।

এই রায় অনুযায়ী, গ্রেপ্তারের কারণ লিখিতভাবে জানাতে হবে। গ্রেপ্তারের সময় একটি গ্রেপ্তার মেমো তৈরি করতে হবে। পরিবারের একজন সদস্যকে অবিলম্বে জানাতে হবে। গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে কোথায় রাখা হয়েছে, তা গোপন রাখা যাবে না। ‘জিজ্ঞাসাবাদের জন্য’ কাউকে আটক করা যাবে না। আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক একাধিক লেখায় উল্লেখ করেছেন, এই নির্দেশনাগুলো কোনো পরামর্শ নয়; এগুলো আইন হিসেবে মান্য।

২৪ ঘণ্টার বিধান: আদালতের তত্ত্বাবধান কেন জরুরি? সিআরপিসি-এর ধারা ৬১ ও ১৬৭ অনুযায়ী- গ্রেপ্তারের পর সর্বোচ্চ ২৪ ঘণ্টা পুলিশি হেফাজতে রাখা যাবে। এরপর আদালতে হাজির করা বাধ্যতামূলক। আদালতের অনুমতি ছাড়া পুলিশি হেফাজত বাড়ানো সম্পূর্ণ অবৈধ। তবু বাস্তবে দেখা যায়- অনেকে তিন, চার এমনকি পাঁচ দিন ‘আটক’ থাকেন, অথচ কাগজে-কলমে গ্রেপ্তার দেখানো হয় না। এটি আইনগতভাবে illegal detention।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জজ কোর্টের ডিবি কে এম খাইরুল কবীর বলেন, ‘আটক বলে কিছু নেই। কেউ যদি পুলিশের নিয়ন্ত্রণে থাকে, সে গ্রেপ্তারকৃত- আইনের চোখে এটাই বাস্তবতা।’

ডিবি, র‌্যাব, অন্যান্য সংস্থা: আলাদা ক্ষমতা আছে কি: অনেকে মনে করেন, ডিবি বা অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থার ক্ষমতা পুলিশের চেয়েও বেশি। এটি একটি ভুল ধারণা।

আইনের দৃষ্টিতে, ডিবি, র‌্যাব বা অন্য কোনো আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা। সংবিধান ও সিআরপিসি-এর ঊর্ধ্বে নয়। মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল বহুবার বলেছেন,     আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ইউনিফর্ম আলাদা হতে পারে, কিন্তু আইনের সীমা একটাই ‘

পরিবারের অজানা আতঙ্ক, একটি মানবিক সংকট: যখন কাউকে তুলে নেওয়া হয় এবং পরিবার জানে না তিনি কোথায় আছেন। বেঁচে আছেন কি না! কোনো মামলা আছে কি না! তখন সেটি শুধু আইনি সমস্যা নয়, একটি গভীর মানবিক সংকট।

একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের ভাষায়, ‘এই অনিশ্চয়তা পরিবারের সদস্যদের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী ট্রমা তৈরি করে, যা অনেক সময় শারীরিক অসুস্থতায়ও রূপ নেয়।’

যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা, আইন কী বলে: গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলতে না দেওয়া, পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ রাখা, এসবের পক্ষে বাংলাদেশের কোনো আইনে সমর্থন নেই।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ড অনুযায়ী, আইনজীবীর সঙ্গে যোগাযোগ করা একটি মৌলিক অধিকার। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রাখা মানে নির্যাতনের ঝুঁকি বৃদ্ধি, জোরপূর্বক স্বীকারোক্তির আশঙ্কা।

আইনের একটি মৌলিক নীতি হলো Presumption of Innocence। অপরাধ প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত কেউ অপরাধী নয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের একজন অধ্যাপক বলেন, ‘আইন যদি শুধু নিরপরাধের জন্য হতো, তবে অপরাধীর বিচারেরই প্রয়োজন পড়ত না। আইন সবার জন্য সমান বলেই এর শক্তি।’

অনেক সাংবাদিকই বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে নেওয়া ব্যক্তিদের বিষয়ে তথ্য পাওয়া কঠিন। কোথায় রাখা হয়েছে, কোনো মামলা আছে কি না- এসব জানতে দিনের পর দিন লেগে যায়। একজন সিনিয়র সাংবাদিকের মন্তব্য, ‘এই অস্বচ্ছতা রাষ্ট্রের ওপর মানুষের আস্থা কমিয়ে দেয়।’

আইনশৃঙ্খলা রক্ষা রাষ্ট্রের দায়িত্ব, কিন্তু সেই দায়িত্ব পালনের নামে যদি সংবিধান ও আইন ভঙ্গ করা হয়, তবে তা রাষ্ট্রকেই দুর্বল করে। আদালতের অনুমতি ছাড়া হেফাজত, পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা, দিনের পর দিন আটকে রাখা- এসব কোনো সভ্য আইনি ব্যবস্থার চিত্র হতে পারে না।

আইনগত দায় কার: যদি আদালতের অনুমতি ছাড়া বেআইনিভাবে কাউকে আটক করা হয়, তবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, নির্দেশদাতা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, সংশ্লিষ্ট সংস্থা সবাই ব্যক্তিগতভাবে দায়ী হতে পারেন। সংবিধান ও দণ্ডবিধি উভয় ক্ষেত্রেই এর ভিত্তি আছে।

ভুক্তভোগীর করণীয়: আইন পুরোপুরি নীরব নয়। ভুক্তভোগী বা পরিবার হাইকোর্টে হেবিয়াস করপাস রিট করতে পারেন। ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে অভিযোগ করতে পারেন। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে আবেদন করতে পারেন।

তবে বাস্তবতা হলো এই পথগুলো সাধারণ মানুষের জন্য সহজ নয়।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষা জরুরি। কিন্তু সেই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যদি সংবিধান ভাঙা হয়, তবে তা আইনশৃঙ্খলা নয়- ক্ষমতার অপব্যবহার। আদালতের অনুমতি ছাড়া দীর্ঘমেয়াদি হেফাজত, পরিবারকে অন্ধকারে রাখা, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা- এসব একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পরিচয় হতে পারে না।

বাংলাদেশের আইনে আদালতের অনুমতি ছাড়া কাউকে দিনের পর দিন পুলিশি বা ডিবি হেফাজতে রাখা বৈধ নয়। অপরাধী হোক বা নিরপরাধ- আইনের সুরক্ষা সবার জন্য সমান। আইনের শাসন তখনই অর্থবহ, যখন তা সবচেয়ে দুর্বল নাগরিকের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য হয়। আতঙ্কের রাষ্ট্র নয়, বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশা একটি ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র- যেখানে আইনই শেষ কথা। 

বিকেপি/এনএ

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

আইন ও আদালত আইনি প্রশ্ন ও উত্তর

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর