Logo

আইন ও বিচার

খুনের মামলায় পলাতক আসামি আইনে কী আত্মীয়স্বজন অপরাধী?

Icon

মাসুম আহম্মেদ

প্রকাশ: ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮:৫০

খুনের মামলায় পলাতক আসামি আইনে কী আত্মীয়স্বজন অপরাধী?

বাংলাদেশে হত্যা মামলা (খুনের মামলা) সর্বাধিক গুরুতর ফৌজদারি অপরাধগুলোর একটি। কিন্তু প্রায়ই দেখা যায়, হত্যার মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তি পলাতক হলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সমাজের চাপ এসে পড়ে তার পরিবারের ওপর। তখন একটি মৌলিক প্রশ্ন সামনে আসে- অভিযুক্ত পলাতক থাকলে তার পিতা-মাতা, স্ত্রী, সন্তান বা ভাই কি আইনের দৃষ্টিতে দায়ী হন?

আইনের স্পষ্ট উত্তর হলো- না, কেবল আত্মীয় হওয়ার কারণে কেউ অপরাধী হন না। তবে কিছু ব্যতিক্রমী পরিস্থিতিতে তাদের বিরুদ্ধে পৃথক অপরাধের অভিযোগ উঠতে পারে।

ব্যক্তিগত দায়ের নীতি: দণ্ডবিধির মৌলিক দর্শন :

বাংলাদেশ দণ্ডবিধির একটি মূল নীতি হলো- ‘অপরাধ ব্যক্তিগত, উত্তরাধিকারসূত্রে বা আত্মীয়তার কারণে অপরাধের দায় বর্তায় না।’

দণ্ডবিধির কোথাও এমন কোনো বিধান নেই যেখানে বলা হয়েছে যে, কোনো ব্যক্তি হত্যার মামলায় অভিযুক্ত হলে তার পিতা-মাতা, স্ত্রী, সন্তান বা ভাই স্বয়ংক্রিয়ভাবে অপরাধী হবেন।

এই নীতির সাংবিধানিক ভিত্তিও রয়েছে। সংবিধানের ৩১ ও ৩৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী- প্রত্যেক নাগরিক আইনের আশ্রয় লাভের অধিকারী, কাউকে তার নিজের অপরাধ ছাড়া দণ্ডিত করা যাবে না।

অতএব, ‘রক্তের সম্পর্ক’ বা ‘পরিবারের পরিচয়’ কখনোই অপরাধের ভিত্তি হতে পারে না।

তবে কি আত্মীয়দের কোনো দায়ই নেই?

আইনের দৃষ্টিতে আত্মীয়রা স্বয়ংক্রিয়ভাবে দায়ী নন, তবে নিচের পরিস্থিতিতে তারা পৃথক অপরাধে অভিযুক্ত হতে পারেন- আসামিকে আশ্রয় বা সহায়তা দিলে। (Harbouring Offender)

দণ্ডবিধির ২১২ ধারা অনুযায়ী- যদি কেউ জেনে-বুঝে কোনো অপরাধীকে আশ্রয় দেয়, লুকিয়ে রাখে বা পালাতে সহায়তা করে, তবে তা একটি স্বতন্ত্র অপরাধ। এই ক্ষেত্রে অপরাধীর আত্মীয় হলেও আইনের চোখে তিনি অপরাধী হতে পারেন।শাস্তি নির্ভর করবে মূল অপরাধের গুরুত্বের ওপর।

তবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যতিক্রম হলো- ২১২ ধারার প্রোভিসো অনুযায়ী, অপরাধীর স্ত্রী, পিতা, মাতা, সন্তান বা ভাই-বোন যদি কেবল আত্মীয়তার কারণে আশ্রয় দেন এবং অন্য কোনো সক্রিয় সহায়তা না করেন, তাহলে অনেক ক্ষেত্রে আদালত শাস্তির ক্ষেত্রে সহানুভূতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি নিতে পারেন। কিন্তু এটি কোনো সম্পূর্ণ দায়মুক্তি নয়।

প্রমাণ নষ্ট বা গোপন করলে : দণ্ডবিধির ২০১ ধারা অনুযায়ী যদি কেউ জানে যে একটি অপরাধ সংঘটিত হয়েছে এবং সেই অপরাধের প্রমাণ নষ্ট করে বা অপরাধীকে বাঁচানোর উদ্দেশ্যে তথ্য গোপন করে, তবে তা গুরুতর অপরাধ। এক্ষেত্রে আত্মীয়-স্বজনের পরিচয় কোনো রক্ষা-কবচ নয়।

মিথ্যা তথ্য বা ভ্রান্ত সাক্ষ্য দিলে ১৮২ ধারায় মিথ্যা তথ্য দিয়ে সরকারি কর্মচারীকে বিভ্রান্ত করা।

১৯৩ ধারা : মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান : এই ধারাগুলোর অধীনে আত্মীয়রাও সমানভাবে দায়ী হতে পারেন। পলাতক আসামি ও পরিবারের হয়রানি : আইনের সীমারেখা।

বাস্তবে অনেক সময় দেখা যায়, পলাতক আসামির বাড়িতে বারবার তল্লাশি। পরিবারের সদস্যদের থানায় ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ। সামাজিক ও প্রশাসনিক চাপ- আইনের দৃষ্টিতে, পরিবারকে হয়রানি করা বা বেআইনিভাবে আটক রাখা সম্পূর্ণ অবৈধ। ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী কাউকে কেবল ‘আত্মীয়’ হওয়ার কারণে গ্রেপ্তার করা যায় না। গ্রেপ্তারের জন্য নির্দিষ্ট অভিযোগ ও যুক্তিসংগত সন্দেহ থাকতে হবে। এ বিষয়ে উচ্চ আদালত একাধিকবার বলেছেন- পলাতক আসামিকে ধরার ব্যর্থতার দায় পরিবারের ওপর চাপানো যাবে না।

নৈতিকতা বনাম আইন : অনেক সময় সামাজিকভাবে বলা হয়- ‘পরিবার নিশ্চয়ই জানে সে কোথায় লুকিয়ে আছে।’ কিন্তু আইন অনুমান বা সন্দেহের ওপর চলে না, চলে প্রমাণ ও নির্দিষ্ট অপরাধমূলক আচরণের ওপর। আইনের কাজ অপরাধীকে শাস্তি দেওয়া, পরিবারকে সমষ্টিগতভাবে দণ্ডিত করা নয়।

হত্যা মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তি পলাতক থাকলেও তার পিতা-মাতা, স্ত্রী, সন্তান বা ভাই আইনের চোখে স্বয়ংক্রিয়ভাবে দায়ী নন। তবে তারা যদি অপরাধীকে আশ্রয় দেন, প্রমাণ গোপন বা নষ্ট করেন, মিথ্যা তথ্য বা সাক্ষ্য দেন তাহলে তারা স্বতন্ত্র অপরাধে অভিযুক্ত হতে পারেন।

আইনের শাসনের মূল কথা হলো অপরাধ ব্যক্তির, পরিবার বা বংশের নয়। এই নীতির প্রতি শ্রদ্ধাই পারে একদিকে যেমন অপরাধ দমন নিশ্চিত করতে, তেমনি অন্যদিকে নিরপরাধ নাগরিকদের অধিকার রক্ষা করতে।

বিকেপি/ এনএ

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

আইনি প্রশ্ন ও উত্তর আইন ও আদালত

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর