Logo

আইন ও বিচার

ইউনিয়ন পরিষদে প্রশাসক নিয়োগ কেন সাংবিধানিক প্রশ্নের মুখে?

Icon

আইন ও আদালত ডেস্ক

প্রকাশ: ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০:৩৩

ইউনিয়ন পরিষদে প্রশাসক নিয়োগ কেন সাংবিধানিক প্রশ্নের মুখে?

স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা বাংলাদেশের সংবিধানের একটি মৌলিক অঙ্গীকার। অথচ সেই স্থানীয় সরকারের সর্বনিম্ন স্তর- ইউনিয়ন পরিষদে প্রশাসক নিয়োগের বিধান নিয়ে এখন গুরুতর সাংবিধানিক প্রশ্ন উঠেছে।

সম্প্রতি হাইকোর্ট ইউনিয়ন পরিষদ (সংশোধন) আইন, ২০২৪-এর ধারা ৭, ৮ ও ৯ কেন অসাংবিধানিক ও অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন। এই রুল কেবল একটি আইনি প্রক্রিয়া নয়; এটি স্থানীয় গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে এক গুরুত্বপূর্ণ বিচারিক পর্যালোচনা।

কী বলছে সংশোধিত আইন? :

ইউনিয়ন পরিষদ (সংশোধন) আইন, ২০২৪-এর বিতর্কিত ধারাগুলোর মাধ্যমে- নির্বাচিত ইউনিয়ন পরিষদের মেয়াদ শেষ হলে অথবা নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে নির্বাচনের পরিবর্তে সরকার কর্তৃক প্রশাসক নিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। এই প্রশাসক নির্বাচিত প্রতিনিধি নন, বরং সরকারের মনোনীত কর্মকর্তা বা ব্যক্তি, যিনি পরিষদের সব কার্যক্রম পরিচালনা করবেন।

হাইকোর্ট কেন রুল জারি করলেন? :

হাইকোর্ট মূলত প্রশ্ন তুলেছেন- সংবিধান যেখানে নির্বাচিত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠার কথা বলেছে, সেখানে নির্বাহী আদেশে প্রশাসক বসানো কি সংবিধানসম্মত? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই ধারা ৭, ৮ ও ৯-এর বৈধতা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।

সংবিধানের আলোকে স্থানীয় সরকার: 

বাংলাদেশের সংবিধানের ৫৯ অনুচ্ছেদ স্পষ্টভাবে বলছে,  ‘স্থানীয় সরকারের প্রতিটি একক নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত হবে।’ এছাড়া ৬০ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানকে প্রশাসনিক ও আর্থিক ক্ষমতা দিতে হবে। এই দুই অনুচ্ছেদ একসঙ্গে পড়লে স্পষ্ট হয়- স্থানীয় সরকার মানেই নির্বাচিত প্রতিষ্ঠান, প্রশাসনিক সুবিধার অজুহাতে নির্বাচনের বিকল্প ব্যবস্থা চালু করা সংবিধানের চেতনার পরিপন্থী।

কেন ধারা ৭, ৮ ও ৯ অসাংবিধানিক হতে পারে? :

 নির্বাচিত প্রতিনিধিত্বের বিলুপ্তি- এই ধারাগুলো কার্যকর হলে ইউনিয়ন পরিষদ কার্যত একটি নির্বাহী নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়, যেখানে জনগণের ভোটাধিকার অকার্যকর হয়ে পড়ে।

সংবিধানের ৫৯ অনুচ্ছেদের সরাসরি লঙ্ঘন :

সংবিধান যেখানে ‘নির্বাচিত প্রতিনিধি’ বাধ্যতামূলক করেছে, সেখানে সাধারণ আইনের মাধ্যমে প্রশাসক বসানো সংবিধানের ওপর আইনের শ্রেষ্ঠত্ব নীতির বিরুদ্ধে।

ক্ষমতার ভারসাম্য নষ্ট :

স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য হলো- ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, প্রশাসক নিয়োগ এই ধারণাকে উল্টো কেন্দ্রীকরণের দিকে ঠেলে দেয়।

নির্বাচন বিলম্বের বৈধতা সৃষ্টি :

এই আইন কার্যত নির্বাচনের পরিবর্তে প্রশাসক বসিয়ে নির্বাচন বিলম্ব বা এড়িয়ে যাওয়ার একটি আইনি আশ্রয় তৈরি করতে পারে, যা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য বিপজ্জনক নজির।

প্রশাসক নিয়োগ কি কখনো সাংবিধানিক হতে পারে? :

রাষ্ট্রপক্ষ সাধারণত যুক্তি দেয়- প্রশাসনিক শূন্যতা এড়াতে, আইনশৃঙ্খলা ও পরিষেবা অব্যাহত রাখতে, অস্থায়ী প্রশাসক নিয়োগ প্রয়োজন। কিন্তু প্রশ্ন হলো- অস্থায়ী ব্যবস্থা কি দীর্ঘমেয়াদি বিকল্প হয়ে উঠতে পারে?

হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণে বারবার বলা হয়েছে- প্রশাসক কেবল সংক্ষিপ্ত ও ব্যতিক্রমী সময়ের জন্য হতে পারে, সেটিও নির্বাচনের সুস্পষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ সাপেক্ষে। ২০২৪ সালের সংশোধনীতে সেই বাধ্যবাধকতা স্পষ্ট নয় বলেই সাংবিধানিক আপত্তি জোরালো হয়েছে।

গণতন্ত্র বনাম প্রশাসনিক সুবিধা- গণতন্ত্র কখনোই প্রশাসনিক সুবিধার কাছে আত্মসমর্পণ করতে পারে না। ইউনিয়ন পরিষদ গ্রামবাংলার মানুষের সবচেয়ে কাছের সরকার। সেখানে যদি জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধি না থেকে প্রশাসক বসে, তবে ভোটাধিকার অর্থহীন হয়ে পড়ে রাজনৈতিক অংশগ্রহণ কমে, স্থানীয় জবাবদিহি ভেঙে পড়ে।

হাইকোর্টের জারি করা রুল একটি স্পষ্ট বার্তা দেয়। স্থানীয় সরকার কোনো দয়া বা সুবিধা নয়; এটি সংবিধানপ্রদত্ত অধিকার। ইউনিয়ন পরিষদ (সংশোধন) আইন, ২০২৪-এর ধারা ৭, ৮ ও ৯ যদি নির্বাচনের মৌলিক ধারণাকে ক্ষুণ্ন করে, তবে তা অসাংবিধানিক ঘোষিত হওয়াই আইনের শাসনের স্বার্থে জরুরি।

গণতন্ত্রের শিকড় গ্রামেই। সেই শিকড়ে প্রশাসনিক কুঠারাঘাত নয়, বরং নির্বাচনের সুরক্ষাই হওয়া উচিত রাষ্ট্রের অগ্রাধিকার।

বিকেপি/এনএ

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

আইনি প্রশ্ন ও উত্তর আইন ও আদালত

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর