আটক আগে, মামলা পরে
আইনের শাসনের জন্য এক বিপজ্জনক প্রবণতা
আইন ও আদালত ডেস্ক
প্রকাশ: ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০:৫৩
আইনের শাসন ও মৌলিক মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রধান ভিত্তি। অথচ বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একটি উদ্বেগজনক প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে- প্রথমে কাউকে আটক করা হচ্ছে, পরে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হচ্ছে। এই চর্চা শুধু আইনগত প্রশ্নই তোলে না, বরং সংবিধান প্রদত্ত নাগরিক অধিকারকেও সরাসরি চ্যালেঞ্জ করে।
সংবিধানের দৃষ্টিতে আটক ও গ্রেপ্তার :
বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৩ অনুচ্ছেদ স্পষ্টভাবে বলে, গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের কারণ দ্রুত জানাতে হবে এবং ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নিকটবর্তী ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করতে হবে। এই বিধান নাগরিকের ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষার একটি মৌলিক নিরাপত্তা বলয়।
ফৌজদারি কার্যবিধি ও আইনি কাঠামো :
ফৌজদারি কার্যবিধির (CrPC) ৫৪ ধারা পুলিশকে কিছু নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে পরোয়ানা ছাড়া গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেয়। তবে এই ক্ষমতা সীমাহীন নয়। সুপ্রিম কোর্টের একাধিক রায়ে (বিশেষ করে BLAST বনাম বাংলাদেশ সরকার মামলা) বলা হয়েছে, ৫৪ ধারার অপব্যবহার রোধে পুলিশকে যথাযথ কারণ লিপিবদ্ধ করতে হবে এবং গ্রেপ্তার যেন হয় শেষ উপায়, প্রথম পদক্ষেপ নয়।
আটক আগে, মামলা পরে- আইনের অতি প্রকৃতি :
আইনের মৌলিক দর্শন হলো- অপরাধ সংঘটিত হলে তার ভিত্তিতে মামলা হবে, এবং মামলার প্রয়োজনে গ্রেপ্তার হবে। এর উল্টো চর্চা, অর্থাৎ আগে আটক পরে মামলা, আইনগতভাবে একটি ব্যতিক্রমী ও সন্দেহজনক প্রক্রিয়া, যা অনেক সময় ক্ষমতার অপব্যবহারের ইঙ্গিত বহন করে।
এই ধরনের আটক কার্যত ‘ডি ফ্যাক্টো প্রিভেন্টিভ ডিটেনশন’-এ পরিণত হয়, যা সংবিধানের ৩৩ অনুচ্ছেদের চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বিশেষ ক্ষমতা আইন (Special Powers Act) থাকলেও, সেটির প্রয়োগের ক্ষেত্রেও নির্দিষ্ট শর্ত ও প্রক্রিয়া মানা বাধ্যতামূলক।
মানবাধিকার ও ন্যায়বিচারের প্রশ্ন :
আটক করে পরে মামলা দেওয়ার প্রবণতা নাগরিকের আইনি প্রতিকার পাওয়ার সুযোগ সংকুচিত করে। একজন ব্যক্তি যখন জানতেই পারেন না তিনি ঠিক কোন অভিযোগে আটক, তখন আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার কার্যত অর্থহীন হয়ে পড়ে। এটি সংবিধানের ৩১ ও ৩৫ অনুচ্ছেদে বর্ণিত ন্যায়বিচার ও সুবিচারের অধিকারকেও ক্ষুণ্ন করে।
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে কয়েকটি বিষয় জরুরি- গ্রেপ্তারের আগে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ও প্রাথমিক প্রমাণ নিশ্চিত করা, ৫৪ ও ১৬৭ ধারার প্রয়োগে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা কঠোরভাবে অনুসরণ, ম্যাজিস্ট্রেটদের আরও সক্রিয় ও স্বাধীন ভূমিকা পালন, বেআইনি আটকের ক্ষেত্রে দ্রুত ও কার্যকর প্রতিকার নিশ্চিত করা।
রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষা গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু তা কখনোই নাগরিকের মৌলিক অধিকার হরণ করে হতে পারে না। আটক আগে, মামলা পরে-এই চর্চা আইনের শাসনের ধারণাকে দুর্বল করে এবং রাষ্ট্র ও নাগরিকের মধ্যে আস্থার সংকট তৈরি করে। আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও সাংবিধানিক নীতির প্রতি শ্রদ্ধাই পারে এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসার পথ দেখাতে।
বিকেপি/এনএ

