সন্ত্রাসবিরোধী আইন বনাম দণ্ডবিধি:
কঠোর আইনের প্রয়োগ কি ন্যায়সংগত?
আইন ও আদালত ডেস্ক
প্রকাশ: ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১:০৬
দেশে সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক সহিংস ঘটনা, রাজনৈতিক সংঘর্ষ ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে নতুন করে আলোচনায় এসেছে একটি গুরুত্বপূর্ণ আইনি প্রশ্ন- কোন অপরাধে সন্ত্রাসবিরোধী আইন প্রযোজ্য হবে, আর কোন ক্ষেত্রে দণ্ডবিধিই যথেষ্ট?
এই প্রশ্ন কেবল আইনি ব্যাখ্যার নয়; এটি নাগরিক অধিকার, ন্যায়বিচার ও আইনের শাসনের সঙ্গেও গভীরভাবে যুক্ত। বাংলাদেশের দণ্ডবিধি, ১৮৬০ মূলত সাধারণ ফৌজদারি অপরাধ- খুন, আহত করা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, দাঙ্গা ইত্যাদি মোকাবিলার জন্য প্রণীত একটি বিস্তৃত আইন। অপরদিকে সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯ একটি বিশেষ আইন, যার উদ্দেশ্য রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি এবং রাষ্ট্রবিরোধী সন্ত্রাসী কার্যক্রম দমন।
আইনের দর্শনগত পার্থক্য এখানেই। দণ্ডবিধি ব্যক্তিকেন্দ্রিক অপরাধকে লক্ষ্য করে। সন্ত্রাসবিরোধী আইন লক্ষ্য করে রাষ্ট্র, জননিরাপত্তা ও সামষ্টিক ভয়ের বিরুদ্ধে অপরাধ।
সাম্প্রতিক সহিংস ঘটনাগুলোতে দেখা যাচ্ছে, রাজনৈতিক বা সামাজিক সংঘর্ষ, যানবাহন ভাঙচুর, সংঘর্ষে আহত ও হতাহতের ঘটনা। এসব ঘটনার পর অনেক ক্ষেত্রেই দণ্ডবিধির পাশাপাশি বা পরিবর্তে সন্ত্রাসবিরোধী আইন প্রয়োগ করা হচ্ছে। এখানেই বিতর্কের সূত্রপাত। প্রশ্ন উঠছে, সব সহিংসতা কি সন্ত্রাস? সব ভাঙচুর কি রাষ্ট্রবিরোধী সন্ত্রাসী কার্যক্রম? সন্ত্রাসবিরোধী আইনের প্রয়োগের শর্ত।
সন্ত্রাসবিরোধী আইন অনুযায়ী, কোনো অপরাধকে ‘সন্ত্রাসী কার্যক্রম’ বলতে হলে সাধারণত থাকতে হয়- জনমনে ব্যাপক আতঙ্ক সৃষ্টি করার উদ্দেশ্য, রাষ্ট্র বা সরকারকে কোনো সিদ্ধান্তে বাধ্য করার লক্ষ্য। আদর্শিক, রাজনৈতিক বা উগ্রবাদী উদ্দেশ্য সংগঠিত ও পরিকল্পিত কার্যক্রম।
এই উপাদানগুলো অনুপস্থিত হলে, আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, দণ্ডবিধিই হওয়া উচিত প্রযোজ্য আইন।
কঠোর আইন প্রয়োগের ঝুঁকি :
সন্ত্রাসবিরোধী আইন অত্যন্ত কঠোর অজামিনযোগ্য অপরাধ, দীর্ঘ তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়া, সর্বোচ্চ শাস্তি পর্যন্ত বিধান। ফলে, প্রাথমিক পর্যায়েই এই আইন প্রয়োগ হলে, অভিযুক্ত ব্যক্তি দীর্ঘদিন বিচারবহির্ভূত ভোগান্তিতে পড়তে পারেন। মামলার প্রকৃত বিচার ব্যাহত হতে পারে। আইনটি রাজনৈতিক বা প্রতিহিংসামূলক অভিযোগের অভিযোগে পড়তে পারে। হাইকোর্ট বিভিন্ন সময় পর্যবেক্ষণ করেছেন-বিশেষ আইন যেন সাধারণ অপরাধের বিকল্প না হয়।
দণ্ডবিধির প্রাসঙ্গিকতা এখনও অপরিহার্য :
বাংলাদেশের দণ্ডবিধিতে রয়েছে, দাঙ্গা (১৪৬-১৪৮ ধারা), হত্যাচেষ্টা (৩০৭ ধারা), অগ্নিসংযোগ (৪৩৫-৪৩৬ ধারা), সরকারি কাজে বাধা (১৮৬ ধারা), অর্থাৎ, অধিকাংশ সহিংস ঘটনার জন্য পর্যাপ্ত ও কার্যকর আইনি কাঠামো ইতোমধ্যেই বিদ্যমান।আইনের শাসন মানে শুধু কঠোরতা নয়; বরং যথাযথ আইন যথাযথ ক্ষেত্রে প্রয়োগ।
সন্ত্রাসবিরোধী আইন প্রয়োগ জরুরি-
যখন প্রকৃত অর্থে সন্ত্রাস রয়েছে, যখন রাষ্ট্র ও জননিরাপত্তা হুমকির মুখে। কিন্তু সাধারণ সহিংসতা বা অপরাধে যদি নিয়মিতভাবে এই আইন প্রয়োগ হয়, তবে -আইনের বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষুণ্ন হবে।
প্রকৃত সন্ত্রাসী ও সাধারণ অপরাধীর পার্থক্য মুছে যাবে। বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা অবশ্যই জরুরি। কিন্তু সেই দায়িত্ব পালনে দণ্ডবিধি ও সন্ত্রাসবিরোধী আইনের সীমারেখা স্পষ্ট রাখা আরও জরুরি।
সন্ত্রাসবিরোধী আইন রাষ্ট্রের জন্য একটি শক্তিশালী অস্ত্র- কিন্তু অস্ত্র যেমন সঠিক লক্ষ্যবস্তুর জন্যই ব্যবহারযোগ্য, তেমনি আইনও প্রয়োগযোগ্য হতে হবে তার যথার্থ প্রেক্ষাপটে। আইনের শাসন টিকে থাকে তখনই, যখন কঠোরতা ও ন্যায়বিচার একে অপরের পরিপূরক হয়- বিকল্প নয়।
বিকেপি/এনএ

