মামলা ছাড়াই সন্ত্রাস দমনের আইনগত বৈধতা : সংবিধান, ফৌজদারি আইন ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সীমা
মাসুম আহম্মেদ
প্রকাশ: ২১ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯:১৬
রাষ্ট্রের অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্নে আইন কখনো নিছক দণ্ডবিধির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। বিশেষত সন্ত্রাসবাদ- যা রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব, জননিরাপত্তা ও সাংবিধানিক কাঠামোকেই চ্যালেঞ্জ করে তা মোকাবিলায় রাষ্ট্রকে কখনো কখনো প্রতিরোধমূলক ও ব্যতিক্রমী আইনগত ক্ষমতা প্রয়োগ করতে হয়। এই বাস্তবতায় একটি মৌলিক প্রশ্ন অনিবার্যভাবে সামনে আসে: কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট মামলা না থাকলেও, যদি রাষ্ট্রের কাছে বিশ্বাসযোগ্য তথ্য থাকে যে সে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত বা জড়িত হতে পারে, তবে তাকে কি আইনের আওতায় আনা সাংবিধানিকভাবে বৈধ?
বাংলাদেশের আইনব্যবস্থা এই প্রশ্নের উত্তর স্পষ্টভাবেই হ্যাঁ বলে, তবে কিছু কঠোর শর্ত ও সীমারেখার মধ্য দিয়ে।
সংবিধানিক ভিত্তি: ব্যক্তিস্বাধীনতা কি সর্বাত্মক? :
বাংলাদেশ সংবিধানের তৃতীয় ভাগে মৌলিক অধিকারসমূহ সংরক্ষিত। ৩১ ও ৩২ অনুচ্ছেদ ব্যক্তিস্বাধীনতা ও আইনের আশ্রয়ের নিশ্চয়তা দিলেও, সংবিধান নিজেই এই অধিকারের ওপর যৌক্তিক সীমাবদ্ধতা আরোপের অনুমোদন দিয়েছে।
সংবিধানের ৩৩ অনুচ্ছেদ বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এখানে বলা হয়েছে- আইনানুযায়ী গ্রেপ্তার ও আটক বৈধ এবং প্রতিরোধমূলক আটক (Preventive Detention) সংবিধানস্বীকৃত। অর্থাৎ, বাংলাদেশের সংবিধান “মামলা না থাকলেও আটক”- এই ধারণাকে নীতিগতভাবে অস্বীকার করেনি; বরং রাষ্ট্রের নিরাপত্তার প্রশ্নে তা স্বীকৃতি দিয়েছে।
ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮ : সন্দেহ ও আশঙ্কার আইনি মূল্য -
ধারা ৫৪: যুক্তিসংগত সন্দেহই যথেষ্ট : ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারা অনুযায়ী, পুলিশ পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেপ্তার করতে পারে যদি কোনো ব্যক্তি আমলযোগ্য অপরাধে জড়িত বলে যুক্তিসংগত সন্দেহ থাকে অথবা সে এমন অপরাধে জড়াতে পারে বলে আশঙ্কা থাকে। সন্ত্রাসবাদ যেহেতু সর্বোচ্চ মাত্রার আমলযোগ্য অপরাধ, সেখানে মামলা না থাকাও গ্রেপ্তারের পথে আইনগত বাধা নয়।
ধারা ১৫১: অপরাধ সংঘটনের আগেই রাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করতে পারে : এই ধারা রাষ্ট্রকে একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা দেয়-অপরাধ সংঘটনের পূর্বেই প্রতিরোধমূলক আটক।
আইনের ভাষায়, যদি জনশান্তি বা নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে, তবে পুলিশ অপরাধ সংঘটনের আগেই পদক্ষেপ নিতে পারে। এটি একটি স্পষ্ট আইনি স্বীকৃতি যে, ফৌজদারি আইন কেবল প্রতিক্রিয়াশীল নয়, প্রতিরোধমূলকও হতে পারে।
বিশেষ ক্ষমতা আইন, ১৯৭৪: রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার ব্যতিক্রমী অস্ত্র :
মামলা ছাড়া আটক সংক্রান্ত সবচেয়ে কঠোর ও বিতর্কিত আইন হলো বিশেষ ক্ষমতা আইন, ১৯৭৪। এই আইনের অধীনে জননিরাপত্তা, আইনশৃঙ্খলা, রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা থাকলে সরকার প্রিভেন্টিভ ডিটেনশন দিতে পারে।
আইনগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এই আটক দণ্ডমূলক নয়, এটি ভবিষ্যৎ ঝুঁকি প্রতিরোধের জন্য। সুপ্রিম কোর্ট একাধিক রায়ে উল্লেখ করেছে, বিশেষ ক্ষমতা আইন অসাংবিধানিক নয়; বরং এর অপব্যবহারই অসাংবিধানিক।
সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯: সন্দেহ থেকে সংগঠন- সবই অপরাধ:
সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯ বাংলাদেশের সন্ত্রাস দমনের মূল আইন। এই আইনের অধীনে সন্ত্রাসী সংগঠন নিষিদ্ধ করা যায়, নিষিদ্ধ সংগঠনের সদস্য হওয়া বা সহায়তা করা অপরাধ, অর্থায়ন, প্রশিক্ষণ বা আশ্রয় দেওয়াও অপরাধ। এখানে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো কোনো নির্দিষ্ট অপরাধ সংঘটিত না হলেও, যদি কারও সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হয়, তবে সে আইনের আওতায় পড়বে। আইনটি স্পষ্টভাবে রাষ্ট্রকে গোয়েন্দা তথ্যভিত্তিক ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ দিয়েছে।
বিচারিক দৃষ্টিভঙ্গি: নিরাপত্তা বনাম অধিকার :
বাংলাদেশের উচ্চ আদালত বারবার বলেছেন, ব্যক্তিস্বাধীনতা গুরুত্বপূর্ণ, তবে তা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার ঊর্ধ্বে নয়। আদালত এটিও স্পষ্ট করেছেন যে, প্রতিরোধমূলক আটক সংবিধানসম্মত, কিন্তু তা হতে হবে যৌক্তিক, নির্দিষ্ট ও সীমাবদ্ধ। এই বিচারিক নজরদারিই নিশ্চিত করে যে, মামলা ছাড়া আটক রাষ্ট্রের হাতে একটি নিয়ন্ত্রিত ক্ষমতা, অবাধ অস্ত্র নয়।
আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্য :
জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সনদ (ওঈঈচজ) পর্যন্ত স্বীকার করে- জাতীয় জরুরি অবস্থায়, জননিরাপত্তার স্বার্থে, ব্যক্তিস্বাধীনতা সীমিত করা যেতে পারে। বাংলাদেশ এই সনদের সদস্য হওয়া সত্ত্বেও, তার আইনগত কাঠামো আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়।
আইনের অপব্যবহার: ঝুঁকি অস্বীকার করা যায় না :
কঠোর আইন মানেই অবারিত ক্ষমতা নয়। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় মামলা ছাড়া আটক কখনো কখনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়েছে। এতে আইনের নৈতিক ভিত্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আইনের শক্তি তখনই কার্যকর, যখন তার প্রয়োগ হয় ন্যায়সংগত ও উদ্দেশ্যনিষ্ঠভাবে।
আইন আছে, কিন্তু দায়িত্বও আছে :
দেশের আইনব্যবস্থা স্পষ্টভাবে বলে- মামলা না থাকলেও সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় আনা বৈধ। সংবিধান, ফৌজদারি কার্যবিধি, বিশেষ ক্ষমতা আইন ও সন্ত্রাসবিরোধী আইন- সবই এই ক্ষমতা রাষ্ট্রকে দিয়েছে। কিন্তু এই ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে একটি কঠোর শর্ত- আইনের শাসন, বিচারিক তত্ত্বাবধান ও মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা। কারণ, শক্তিশালী রাষ্ট্র মানে শুধু কঠোর আইন নয়, শক্তিশালী রাষ্ট্র মানে এমন আইন, যা সন্ত্রাসকে দমন করে কিন্তু ন্যায়বিচারকে হত্যা করে না।
বিকেপি/এমবি

