Logo

আইন ও বিচার

যৌতুক মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি : ন্যায়বিচার বিলম্বিত হওয়া মানেই অবিচার

Icon

বায়েজিদ তাশরিক

প্রকাশ: ২১ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০:০০

যৌতুক মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি : ন্যায়বিচার বিলম্বিত হওয়া মানেই অবিচার

যৌতুক প্রথা উপমহাদেশের সমাজব্যবস্থার একটি গভীর ক্ষত। আইন, আদালত ও সামাজিক আন্দোলন- সবকিছুর পরও এই ঘৃণ্য প্রথা আজও নানা রূপে টিকে আছে। যৌতুকের দাবিতে নির্যাতন, মামলা, আত্মহত্যা কিংবা হত্যার ঘটনা প্রায়ই সংবাদ শিরোনামে আসে। কিন্তু সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হলো- যৌতুক সংক্রান্ত মামলাগুলোর অধিকাংশই বছরের পর বছর আদালতে ঝুলে থাকে। ফলে ভুক্তভোগীরা যেমন ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হন, তেমনি অপরাধীরা আইনের ফাঁক গলে পার পেয়ে যায়। এই বাস্তবতায় যৌতুক মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি এখন আর শুধু আইনি প্রয়োজন নয়, এটি একটি জরুরি সামাজিক দাবি।

আইনের মূল উদ্দেশ্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। কিন্তু যখন একটি মামলা নিষ্পত্তি হতে ৫, ৭ কিংবা ১০ বছর লেগে যায়, তখন সেই ন্যায়বিচার কার্যত অর্থহীন হয়ে পড়ে। বিশেষ করে যৌতুক মামলার ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী অধিকাংশ সময় নারী, যিনি ইতোমধ্যে শারীরিক, মানসিক ও সামাজিকভাবে বিপর্যস্ত। দীর্ঘ বিচারপ্রক্রিয়া তার জীবনকে আরও অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেয়। অনেক ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী আর্থিক ও মানসিক চাপ সহ্য করতে না পেরে মামলা তুলে নিতে বাধ্য হন- যা ন্যায়বিচারের ধারণাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে।

যৌতুক মামলার দীর্ঘসূত্রিতার পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে। প্রথমত, আদালতে মামলার অতিরিক্ত চাপ। ফৌজদারি ও দেওয়ানি মামলার ভিড়ে যৌতুক মামলাগুলো আলাদা গুরুত্ব পায় না। দ্বিতীয়ত, তদন্ত প্রক্রিয়ার দুর্বলতা। অনেক সময় পুলিশি তদন্ত সময়মতো শেষ হয় না কিংবা তদন্তে গাফিলতি থাকে, যার ফলে মামলা দুর্বল হয়ে পড়ে। তৃতীয়ত, অপ্রয়োজনীয় সময়ক্ষেপণ- আইনজীবীদের অনুপস্থিতি, সাক্ষীর হাজির না হওয়া কিংবা একের পর এক তারিখ পরিবর্তন। এসব মিলিয়ে একটি সহজে নিষ্পত্তিযোগ্য মামলাও বছরের পর বছর ঝুলে থাকে।

এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য প্রথম এবং সবচেয়ে কার্যকর পদক্ষেপ হতে পারে যৌতুক ও নারী নির্যাতন সংক্রান্ত মামলার জন্য আলাদা ফাস্ট ট্র্যাক আদালত প্রতিষ্ঠা। বিশেষ আদালত থাকলে নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে শুনানি ও রায় দেওয়া সম্ভব হবে। অনেক দেশে নারী ও শিশু নির্যাতন মামলায় ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট ইতিবাচক ফল দিয়েছে। আমাদের দেশেও সেই উদ্যোগকে আরও কার্যকর ও বিস্তৃত করতে হবে।

দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো তদন্ত প্রক্রিয়ার সংস্কার। যৌতুক মামলায় তদন্তের জন্য নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করতে হবে এবং তা কঠোরভাবে অনুসরণ করতে হবে। তদন্ত কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ বাড়ানো জরুরি, যাতে তারা সংবেদনশীলতা ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে এসব মামলা পরিচালনা করতে পারেন। দুর্বল তদন্ত মানেই দুর্বল বিচার-এই বাস্তবতা অস্বীকার করার সুযোগ নেই।

তৃতীয়ত, বিচারপ্রক্রিয়ায় সময়ক্ষেপণের সংস্কৃতি বন্ধ করতে হবে। অযৌক্তিক কারণে তারিখ পরিবর্তন কিংবা আইনজীবীর অনুপস্থিতির বিষয়টি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। সাক্ষী হাজির না হলে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়িয়ে অনলাইন সাক্ষ্যগ্রহণ বা ভার্চুয়াল শুনানির সুযোগ বাড়ানো যেতে পারে, যাতে সময় ও খরচ-দুটোই কমে।

চতুর্থত, আইনগত সহায়তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। অনেক ভুক্তভোগী নারী আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে ভালো আইনজীবী নিয়োগ করতে পারেন না। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো তাদের জন্য বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে আইনি সহায়তা নিশ্চিত করা। একই সঙ্গে মামলা চলাকালীন ভুক্তভোগীর নিরাপত্তা, মানসিক সহায়তা ও সামাজিক সুরক্ষাও নিশ্চিত করতে হবে।

পঞ্চমত, মধ্যস্থতা ও সমঝোতার বিষয়টি সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করা যেতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে পারিবারিক সমঝোতার মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তি সম্ভব হলেও তা কখনোই ভুক্তভোগীর ওপর চাপ সৃষ্টি করে হওয়া উচিত নয়। যৌতুক একটি অপরাধ- এটি কোনোভাবেই বৈধ লেনদেন নয়। তাই সমঝোতার নামে অপরাধকে বৈধতা দেওয়া চলবে না। 

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও জবাবদিহিতা। আইন থাকলেও যদি তার কার্যকর প্রয়োগ না হয়, তবে সেই আইন কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ থাকে। পুলিশ, প্রসিকিউশন ও বিচার বিভাগ- সব স্তরেই জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাবমুক্ত বিচার নিশ্চিত করাও জরুরি।

যৌতুক মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি কেবল একটি আইনি সংস্কার নয়, এটি সমাজের প্রতি একটি শক্ত বার্তা। দ্রুত ও দৃষ্টান্তমূলক বিচার হলে সমাজে যৌতুকের বিরুদ্ধে ভীতি তৈরি হবে। মানুষ বুঝবে- যৌতুক নেওয়া বা দেওয়া কোনো সামাজিক রীতি নয়, এটি একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

সবশেষে বলা যায়, যৌতুকের বিরুদ্ধে লড়াই শুধু আদালতের একার দায়িত্ব নয়। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র- সবার সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন। তবে সেই উদ্যোগের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতে হবে দ্রুত ও কার্যকর বিচার। ন্যায়বিচার যদি বিলম্বিত হয়, তবে তা আর ন্যায়বিচার থাকে না- এই সত্য উপলব্ধি করেই যৌতুক মামলার দ্রুত নিষ্পত্তিতে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

বিকেপি/এমবি

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

আইন ও আদালত

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর