কৃষকের হাতে নিরাপদ শস্যবীজ ও কৃষি বিষ : দায়িত্ব কার, ব্যর্থতা কোথায়?
মাসুম আহম্মেদ
প্রকাশ: ২২ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮:৪৯
কৃষিই বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড। খাদ্য নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান এবং গ্রামীণ অর্থনীতির প্রধান ভরসা এই খাত। অথচ সেই কৃষিখাতেই আজ সবচেয়ে বেশি অনিশ্চয়তা- বিশেষ করে শস্যবীজ ও কৃষি বিষ (পেস্টিসাইড) প্রাপ্তি, মান ও সঠিক ব্যবহারের প্রশ্নে। কৃষকের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য এসব উপকরণ অপরিহার্য হলেও, বাস্তবে তা অনেক সময় কৃষকের জন্য আশীর্বাদ নয়, বরং ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
কৃষকের জন্য মানসম্মত শস্যবীজ ও অনুমোদিত কৃষি বিষ নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এই দায়িত্ব বাস্তবায়নের মূল ভার পড়ে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তাদের ওপর এবং নীতিগতভাবে কৃষি অধিদপ্তরের ওপর। কিন্তু মাঠপর্যায়ের বাস্তবতা বলছে- এই ব্যবস্থাপনায় এখনো বড় ঘাটতি রয়ে গেছে। অনেক কৃষকই জানেন না, কোন বিষটি কোন ফসলে ব্যবহারযোগ্য, কোনটি নিষিদ্ধ, কিংবা কী মাত্রায় ব্যবহার করা নিরাপদ।
বাংলাদেশে কৃষি বিষ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে পেস্টিসাইড আইন, ২০১৮ এবং সংশ্লিষ্ট বিধিমালা। এই আইন অনুযায়ী, অনুমোদনহীন বা নিষিদ্ধ কৃষি বিষ আমদানি, উৎপাদন, বাজারজাত ও ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। একইভাবে, ভেজাল বা মানহীন শস্যবীজ বিক্রির বিরুদ্ধেও আইন আছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো- আইন থাকলেও মাঠে তার প্রয়োগ কতটা কার্যকর?
বাস্তবে দেখা যায়, অনেক জেলায় এখনো অবাধে বিক্রি হচ্ছে অনুমোদনহীন বা নিম্নমানের কৃষি বিষ। কোথাও আবার একই বিষ ভিন্ন নামে বাজারে ছাড়া হচ্ছে। কৃষক প্রতারিত হচ্ছেন, ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, আর দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতি হচ্ছে মাটি, পানি ও জনস্বাস্থ্যের। এই পরিস্থিতিতে জেলা কৃষি কর্মকর্তাদের ভূমিকা প্রশ্নের মুখে পড়ছে। তদারকি কি যথেষ্ট হচ্ছে? বাজার মনিটরিং কি নিয়মিত হচ্ছে? নাকি এসব কার্যক্রম কেবল কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ?
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বর্তমান বাস্তবতায় জেলা কৃষি কর্মকর্তাদের আরও নতুন চিন্তাধারা ও উদার মানসিকতা নিয়ে কাজ করা জরুরি। শুধু প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করলেই চলবে না; কৃষকের পাশে দাঁড়িয়ে পরামর্শ দেওয়া, সচেতনতা তৈরি করা এবং নিরাপদ কৃষি উপকরণ ব্যবহারে উৎসাহিত করাই হওয়া উচিত মূল লক্ষ্য। অনেক কৃষক আজও নির্ভর করেন দোকানির পরামর্শের ওপর, যেখানে লাভের স্বার্থই প্রাধান্য পায়- কৃষকের নিরাপত্তা নয়।
এখানে কৃষি অধিদপ্তরের ভূমিকা আরও গুরুত্বপূর্ণ। কেন্দ্র থেকে মাঠপর্যায় পর্যন্ত একটি শক্তিশালী নজরদারি ব্যবস্থা গড়ে না উঠলে, আইন বাস্তবায়ন কার্যত দুর্বলই থেকে যাবে। কৃষি অধিদপ্তরের উচিত-
প্রথমত, শস্যবীজ ও কৃষি বিষের বাজারে নিয়মিত ও আকস্মিক পরিদর্শন জোরদার করা। দ্বিতীয়ত, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ বাড়ানো, যাতে তারা আধুনিক ও পরিবেশবান্ধব কৃষি পদ্ধতি সম্পর্কে হালনাগাদ জ্ঞান দিতে পারেন।
তৃতীয়ত, কৃষকদের জন্য সহজ ভাষায় নির্দেশিকা ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালু করা।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো বিপণন ব্যবস্থা। বর্তমানে কৃষি উপকরণ বিপণনে মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাব অত্যন্ত বেশি। অনেক সময় কোম্পানি ও ডিলারদের চাপেই নির্দিষ্ট বিষ বা বীজ কৃষকের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। এই অস্বচ্ছ বিপণন ব্যবস্থায় কৃষকই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। ফলে কৃষি উৎপাদনের খরচ বাড়ে, লাভ কমে, আর ঝুঁকি বাড়ে বহুগুণ।
এ অবস্থায় আইন ও নীতিমালার পাশাপাশি দায়িত্বশীল প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত জরুরি। কৃষি বিষ ব্যবহারে শুধু উৎপাদন বাড়ানোর দৃষ্টিভঙ্গি নয়, পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টিও সমান গুরুত্ব পেতে হবে। অতিরিক্ত ও ভুলভাবে ব্যবহৃত কৃষি বিষ শুধু ফসল নয়, মানুষের জীবনকেও হুমকির মুখে ফেলছে- এটি আর অস্বীকার করার সুযোগ নেই।
কৃষকের স্বার্থে এখনই কিছু স্পষ্ট সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি। অনুমোদনহীন ও ক্ষতিকর কৃষি বিষের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ। জেলা কৃষি কর্মকর্তাদের মাঠপর্যায়ে আরও সক্রিয় ও জবাবদিহিমূলক ভূমিকা নিশ্চিত করা। কৃষি অধিদপ্তরের কেন্দ্রীয় নজরদারি ও সমন্বয় শক্তিশালী করা। কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা বাড়িয়ে নিরাপদ ও টেকসই কৃষি ব্যবস্থায় উৎসাহ দেওয়া।
কৃষক বাঁচলে কৃষি বাঁচবে, কৃষি বাঁচলে দেশ বাঁচবে- এই সত্য নতুন নয়। কিন্তু সেই কৃষক যদি ভেজাল বীজ, ভুল কৃষি বিষ আর দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হন, তাহলে খাদ্য নিরাপত্তা শুধু স্লোগান হয়েই থাকবে। এখনই যদি আইন, তদারকি ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয় না করা হয়, তাহলে এর মাশুল দিতে হবে পুরো জাতিকেই।
কৃষকের হাতে নিরাপদ শস্যবীজ ও কৃষি বিষ নিশ্চিত করা কোনো দয়া নয়, এটি রাষ্ট্রের দায়িত্ব। সেই দায়িত্ব পালনে আর দেরি করার সুযোগ নেই।
বিকেপি/এমবি

