গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় জনগণের জানার অধিকার একটি মৌলিক অধিকার। এই অধিকার নিশ্চিত করতেই বাংলাদেশে প্রণীত হয় তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯। আইনটি প্রণয়নের সময় ব্যাপক প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল- রাষ্ট্রের স্বচ্ছতা বাড়বে, জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে, দুর্নীতি কমবে। কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, আইনটি কার্যকর হওয়ার এক যুগ পেরিয়ে গেলেও এর কাক্সিক্ষত সুফল আজও পুরোপুরি পাওয়া যাচ্ছে না।
আইনে বলা হয়েছে, যেকোনো নাগরিক নির্ধারিত পদ্ধতিতে সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে তথ্য চাইতে পারবেন। সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে সর্বোচ্চ ২০ কার্যদিবসের মধ্যে তথ্য সরবরাহ করতে হবে। জরুরি ক্ষেত্রে এই সময়সীমা আরও কম। তথ্য প্রদানে ব্যর্থ হলে বা অযৌক্তিকভাবে বিলম্ব করলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে জরিমানা ও শাস্তির বিধানও রয়েছে। কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন। বহু ক্ষেত্রেই তথ্য চেয়ে আবেদন করলে উত্তর আসে না, কিংবা “তথ্য সংরক্ষিত নয়”, “গোপনীয়”, “উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি প্রয়োজন”-এমন অস্পষ্ট অজুহাতে আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়। অনেক দপ্তরে এখনো তথ্য প্রদানের জন্য নির্ধারিত তথ্য কর্মকর্তা কার্যকর ভূমিকা রাখছেন না। কোথাও তারা আইনের বিধান সম্পর্কে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নন, কোথাও আবার তথ্য না দেওয়ার প্রবণতাই প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। আরও উদ্বেগজনক বিষয় হলো, তথ্য অধিকার আইন প্রয়োগকারী সংস্থা হিসেবে তথ্য কমিশনের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। অভিযোগ নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা, জরিমানার হার কম, এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির অভাব আইনের ভয় ও কার্যকারিতা-দুটোই কমিয়ে দিয়েছে। ফলে তথ্য না দেওয়ার প্রবণতা অনেক ক্ষেত্রে ঝুঁকিমুক্ত আচরণে পরিণত হয়েছে।
আইনের আরেকটি বড় দুর্বলতা হলো সচেতনতার অভাব। সাধারণ মানুষ তো বটেই, অনেক শিক্ষিত নাগরিকও জানেন কীভাবে তথ্য চাইতে হয়, কোথায় আবেদন করতে হয়, বা তথ্য না পেলে কী প্রতিকার রয়েছে। অন্যদিকে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটি অংশ তথ্যকে জনগণের অধিকার হিসেবে নয়, বরং নিজেদের “দয়া” হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত। অথচ তথ্য অধিকার আইন কার্যকরভাবে প্রয়োগ হলে সরকারি ব্যয়, উন্নয়ন প্রকল্প, নিয়োগ প্রক্রিয়া ও সেবাদানের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা বহুগুণে বাড়তে পারত। দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এটি হতে পারত একটি শক্তিশালী হাতিয়ার।
এ অবস্থায় সময়ের দাবি হলো- প্রথমত, তথ্য কমিশনকে আরও স্বাধীন, সক্রিয় ও শক্তিশালী করা। দ্বিতীয়ত, তথ্য কর্মকর্তাদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও জবাবদিহিতার আওতায় আনা। তৃতীয়ত, তথ্য না দেওয়ার ক্ষেত্রে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা। চতুর্থত, গণমাধ্যম ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তথ্য অধিকার সম্পর্কে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টি করা।
তথ্য অধিকার আইন কাগজে শক্তিশালী থাকলেই হবে না; বাস্তবে তার প্রয়োগ নিশ্চিত করতে না পারলে এই আইন একটি নিষ্প্রভ আইনি দলিলে পরিণত হবে। গণতন্ত্রের স্বার্থে, সুশাসনের স্বার্থে- তথ্য অধিকার আইনকে আবার কার্যকর ও প্রাণবন্ত করে তোলার এখনই সময়।
বিকেপি/এমবি

