Logo

আইন ও বিচার

কৃষি জমি বর্গা কিংবা রেহান রেখে ঋণ নিয়ে চাষাবাদ

বাংলাদেশ ও বিশ্বের আইনি দৃষ্টিভঙ্গি

Icon

আইন ও আদালত ডেস্ক

প্রকাশ: ২৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮:৪১

বাংলাদেশ ও বিশ্বের আইনি দৃষ্টিভঙ্গি

বাংলাদেশের কৃষিভিত্তিক সমাজব্যবস্থায় জমি শুধু উৎপাদনের মাধ্যম নয়, বরং জীবিকা, নিরাপত্তা ও সামাজিক মর্যাদার প্রতীক। বাস্তবতায় দেখা যায়, আর্থিক সংকটে পড়ে অনেক কৃষক জমি বর্গা দেন কিংবা রেহান (বন্ধক) রেখে ঋণ নিয়ে চাষাবাদ চালিয়ে যান। এই প্রথা যুগের পর যুগ ধরে চলে আসলেও প্রশ্ন থেকে যায়- বাংলাদেশের আইন এ বিষয়ে কী বলে? এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশে এই ব্যবস্থার আইনি কাঠামো কেমন?

বর্গা চাষ : বাংলাদেশের আইনি কাঠামো

বাংলাদেশে বর্গা চাষের প্রধান আইন হলো প্রজাস্বত্ব আইন, ১৯৫০ (State Acquisition and Tenancy Act, 1950)। এই আইন অনুযায়ী, জমির মালিক ও বর্গাচাষির মধ্যে উৎপাদিত ফসল ভাগাভাগির ভিত্তিতে চাষাবাদ বৈধ। আইন বর্গাচাষিকে স্বীকৃতি দেয় এবং নির্দিষ্ট কিছু অধিকার নিশ্চিত করে।

আইন অনুসারে, বর্গাচাষি জমি চাষের অধিকার পাবে, ফসল উৎপাদনে বর্গাচাষির শ্রমের স্বীকৃতি থাকবে, জমির মালিক ইচ্ছামতো বর্গাচাষিকে উচ্ছেদ করতে পারবেন না। তবে বাস্তবে অনেক ক্ষেত্রে লিখিত চুক্তির অভাব থাকায় বর্গাচাষির অধিকার ক্ষুণ্ন হয়। আইন থাকলেও এর প্রয়োগ দুর্বল হওয়ায় গ্রামীণ পর্যায়ে বর্গাচাষ আজও অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে।

রেহান বা বন্ধক রেখে ঋণ : আইন কী বলে? :

রেহান বা বন্ধক রেখে ঋণ নেওয়া বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতিতে একটি বহুল প্রচলিত পদ্ধতি। এ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য আইনগুলো হলো, সম্পত্তি হস্তান্তর আইন, ১৮৮২ (Transfer of Property Act) চুক্তি আইন, ১৮৭২।

এই আইন অনুযায়ী, জমি বন্ধক রেখে ঋণ নেওয়া বৈধ, যদি তা লিখিত চুক্তির মাধ্যমে হয়। বন্ধকগ্রহীতা ঋণ পরিশোধ না হলে নির্দিষ্ট শর্তে জমির দখল বা বিক্রির অধিকার পেতে পারেন, তবে তা অবশ্যই আদালতের মাধ্যমে হতে হবে।

আইন স্পষ্টভাবে বলে, বন্ধক মানেই জমি বিক্রি নয়। ঋণ পরিশোধের পর জমি ফেরত দেওয়া বাধ্যতামূলক।

জোরপূর্বক দখল বা প্রতারণামূলক দলিল শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, অনেক নিরক্ষর কৃষক না বুঝেই জমি বন্ধক দিয়ে দীর্ঘমেয়াদে জমি হারান। আইনের অপব্যবহার এখানেই সবচেয়ে বেশি।

বর্গা ও রেহানের সামাজিক বাস্তবতা

বাংলাদেশে বর্গা ও রেহান মূলত দারিদ্র্য, কৃষি উপকরণের উচ্চমূল্য এবং প্রাতিষ্ঠানিক ঋণের অভাব থেকে জন্ম নিয়েছে। ব্যাংক ঋণ পেতে জটিলতা থাকায় কৃষক মহাজনের শরণাপন্ন হন। এতে সুদের হার বেশি হয় এবং জমি হারানোর ঝুঁকি বাড়ে।

আইন থাকা সত্ত্বেও গ্রামীণ পর্যায়ে আইনি সহায়তা ও সচেতনতার অভাব কৃষকদের আরও দুর্বল করে তোলে। ফলে আইন অনেক সময় কাগজেই সীমাবদ্ধ থাকে।

বিশ্বের অন্যান্য দেশের আইনি চিত্র

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কৃষি জমি বর্গা ও বন্ধক ব্যবস্থার ভিন্ন ভিন্ন আইনি কাঠামো রয়েছে।

ভারত: 

ভারতের অধিকাংশ রাজ্যে বর্গাচাষ নিয়ন্ত্রণে আলাদা আইন রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে ‘অপারেশন বর্গা’ কর্মসূচির মাধ্যমে বর্গাচাষিদের নিবন্ধন ও অধিকার সুরক্ষিত করা হয়েছে। এতে বর্গাচাষির উচ্ছেদ কমেছে।

জাপান: 

জাপানে কৃষি জমি ইজারা ও বন্ধক রাষ্ট্রের কঠোর নিয়ন্ত্রণে। কৃষক ছাড়া অন্য কেউ কৃষিজমির মালিক হতে পারে না। ফলে জমি হারানোর ঝুঁকি কম।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন:

ইইউ দেশগুলোতে কৃষি জমি বন্ধক রেখে ঋণ নেওয়া বৈধ, তবে কৃষকের স্বার্থ রক্ষায় কম সুদের কৃষিঋণ এবং রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি রয়েছে। আইনি সহায়তাও সহজলভ্য।

কিছু আফ্রিকান দেশে জমি বর্গা প্রথা প্রচলিত হলেও আইনি দুর্বলতার কারণে জমি দখল ও কৃষক নিঃস্ব হওয়ার ঘটনা বেশি।

বিশ্বের অভিজ্ঞতা বলে- আইন থাকাই যথেষ্ট নয়, কার্যকর বাস্তবায়ন ও প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা অপরিহার্য। যেসব দেশে বর্গাচাষি ও ক্ষুদ্র কৃষকের অধিকার সুরক্ষিত, সেখানে কৃষি উৎপাদনও স্থিতিশীল।

বাংলাদেশে এখনো কৃষিঋণ ব্যবস্থাকে আরও সহজ ও কৃষকবান্ধব করতে হবে, যাতে কৃষক মহাজনি ঋণের ফাঁদে না পড়েন।

বিকেপি/এনএ

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

আইন ও আদালত

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর