তালাকের পর দেনমোহর : নারীর অধিকার কি এখনো কাগুজে আশ্বাস?
মাসুম আহম্মেদ
প্রকাশ: ২৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯:৩৪
দেশে নারীর অধিকার নিয়ে রাষ্ট্রের অঙ্গীকার নতুন নয়। সংবিধান, আইন, আন্তর্জাতিক চুক্তি- সবখানেই নারীর মর্যাদা ও অধিকার সুরক্ষার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তব জীবনে একজন তালাকপ্রাপ্ত নারীর সবচেয়ে মৌলিক অধিকারগুলোর একটি দেনমোহর, যখন আদায় হয় না, তখন প্রশ্ন ওঠে: এই আইনগুলো কি কেবল কাগজেই সীমাবদ্ধ?
ইসলামি শরিয়ত ও বাংলাদেশের মুসলিম পারিবারিক আইন উভয় ক্ষেত্রেই দেনমোহর নারীর একটি আবশ্যিক ও অবিচ্ছেদ্য অধিকার। এটি কোনো দয়া নয়, কোনো অনুগ্রহ নয়, বরং স্বামীর ওপর আরোপিত একটি আইনগত ও নৈতিক দায়িত্ব। তালাকের সঙ্গে সঙ্গে দেনমোহর পরিশোধযোগ্য হয়ে যায়। তবু বাস্তবতা হলো, তালাকের পর অধিকাংশ নারীই এই ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হন।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক প্রশ্নটি হলো, দেনমোহর না দিলে কি সত্যিই কোনো শাস্তি হয়? উত্তরটি হতাশাজনক। বাংলাদেশে দেনমোহর পরিশোধ না করা একটি দেওয়ানি অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়। অর্থাৎ, টাকা আদায়ের জন্য নারীকে নিজেই মামলা করতে হবে, আদালতের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হবে, বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু ইচ্ছাকৃতভাবে টাকা না দেওয়ার জন্য স্বামীর বিরুদ্ধে সরাসরি কারাদণ্ডের বিধান নেই। এই আইনি দুর্বলতাই নারীর প্রতি চরম বৈষম্যের জন্ম দিচ্ছে।
একজন তালাকপ্রাপ্ত নারী যখন দেনমোহরের টাকা না পেয়ে পারিবারিক আদালতে যান, তখন তাকে শুধু একজন বিবাদীর সঙ্গে নয়- একটি পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোর সঙ্গেই লড়াই করতে হয়। মামলা করতে খরচ লাগে, সময় লাগে, সামাজিক চাপ সহ্য করতে হয়। অনেক নারী এই লড়াই শুরুর আগেই হেরে যান। ফলে দেনমোহর থেকে যায় কেবল বিবাহনামার একটি সংখ্যা, বাস্তবে যার কোনো মূল্য নেই।
অন্যদিকে, অনেক পুরুষ এই আইনি ফাঁককে কৌশলে ব্যবহার করেন। তালাক দিয়ে নির্বিঘ্নে নতুন জীবন শুরু করেন, কিন্তু পূর্বতন স্ত্রীর ন্যায্য পাওনার দায় এড়িয়ে যান। সমাজও অনেক সময় এই অন্যায়কে নীরবে সমর্থন করে। বলা হয়- “এত টাকা কই পাবে?”, “ছেড়ে দিয়েছে তো, আর কেন টাকা চাইবে?”- এই প্রশ্নগুলো আসলে নারীর অধিকারকে অস্বীকার করারই আরেক নাম।
এখানে স্পষ্ট করে বলা দরকার, দেনমোহর না দেওয়া কোনো ব্যক্তিগত সমস্যা নয়; এটি নারীর অর্থনৈতিক অধিকার লঙ্ঘন। তালাকের পর একজন নারী যখন কর্মসংস্থানহীন, সামাজিকভাবে দুর্বল অবস্থায় পড়েন, তখন দেনমোহরই হতে পারে তার প্রথম নিরাপত্তা। সেই অধিকার কেড়ে নেওয়া মানে তাকে আরও অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেওয়া।
আইন আছে, কিন্তু কার্যকর প্রয়োগ নেই- এটাই মূল সংকট। পারিবারিক আদালত দেনমোহর আদায়ের আদেশ দিতে পারেন, সম্পত্তি জব্দের নির্দেশ দিতে পারেন। কিন্তু বাস্তবে এই আদেশ কার্যকর হতে দীর্ঘ সময় লাগে। অনেক ক্ষেত্রে প্রভাবশালী বা অর্থবান বিবাদীরা রায় বাস্তবায়ন ঠেকিয়ে রাখেন বছরের পর বছর। প্রশ্ন হলো, এই বিলম্বের মূল্য কে দিচ্ছে? দিচ্ছে সেই নারী, যিনি ইতোমধ্যেই সম্পর্ক, নিরাপত্তা ও সামাজিক মর্যাদা হারিয়েছেন।
এ অবস্থায় রাষ্ট্রের ভূমিকা আরও স্পষ্ট ও দৃঢ় হওয়া জরুরি। দেনমোহর পরিশোধে ইচ্ছাকৃত অবহেলাকে কেবল দেওয়ানি বিষয় হিসেবে না দেখে, নারীর অধিকার লঙ্ঘনের গুরুতর অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করার সময় এসেছে। দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা, সহজ প্রক্রিয়া, বিনা খরচে আইনি সহায়তা এবং প্রয়োজনে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা—এসব ছাড়া ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে না।
একই সঙ্গে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনও অপরিহার্য। দেনমোহরকে যেন আর “বিরোধের হাতিয়ার” বা “অপ্রয়োজনীয় দাবি” হিসেবে না দেখা হয়। এটি নারীর সম্মান ও নিরাপত্তার প্রতীক। ধর্ম, আইন ও নৈতিকতা- তিনটি ক্ষেত্রেই এর গুরুত্ব সুস্পষ্ট।
নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে যত কথা বলা হয়, তার বাস্তব পরীক্ষা হয় তালাকপ্রাপ্ত নারীর জীবনে। তিনি কি আইনের আশ্রয় নিয়ে ন্যায্য অধিকার আদায় করতে পারেন? নাকি সমাজ ও ব্যবস্থার চাপে নীরবে হার মানেন? এই প্রশ্নের উত্তরই বলে দেবে আমরা আসলে কতটা ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র।
তালাক একটি সম্পর্কের শেষ হতে পারে, কিন্তু নারীর অধিকার সেখানে শেষ হওয়ার কথা নয়। দেনমোহর পরিশোধ নিশ্চিত করা শুধু আইনের প্রয়োগ নয়, এটি নারীর মর্যাদা রক্ষার প্রশ্ন। যতদিন একজন নারী তার ন্যায্য পাওনা আদায়ে অসহায় থাকবেন, ততদিন নারীর অধিকার নিয়ে সব বক্তব্যই ফাঁপা শোনাবে।
এখন সময় এসেছে আইনকে নারীর পাশে দাঁড় করানোর, কাগুজে অধিকারকে বাস্তব নিরাপত্তায় রূপ দেওয়ার।
বিকেপি/এমবি

