কর্মস্থলে মৃত্যুই কি নির্মাণ শ্রমিকের নিয়তি, দূর করতে হবে দায় এড়ানোর সংস্কৃতি
হাফিজুর রহমান খান
প্রকাশ: ২৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১:১৩
উঁচু ভবনের ছাদ থেকে পড়ে মৃত্যু, নির্মাণাধীন ভবন ধসে প্রাণহানি, বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনায় শ্রমিকের মৃত্যু- বাংলাদেশে এসব আর শিরোনাম নয়, যেন নিয়মিত সংবাদ। প্রতিটি মৃত্যুর পর কিছুদিন আলোচনা হয়, দায় চাপানো হয় “দুর্ঘটনার” ঘাড়ে, তারপর সব চুপচাপ। প্রশ্ন থেকে যায়- কাজ করতে গিয়ে নির্মাণ শ্রমিকের মৃত্যু হলে দায়টা আসলে কার? এই প্রশ্নের উত্তর আইনেও আছে, বিবেকেও আছে। কিন্তু বাস্তবে দায় নেওয়ার মানুষ খুঁজে পাওয়া যায় না।
বাংলাদেশের শ্রমবাজারে নির্মাণ খাত সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। লাখো শ্রমিক প্রতিদিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেন, অথচ নিরাপত্তা ব্যবস্থার বালাই নেই বললেই চলে। হেলমেট, সেফটি বেল্ট, গøাভস- এসব যেন বিলাসিতা। মৃত্যুর পর বলা হয়, “শ্রমিক নিজেই অসতর্ক ছিল।” এই দায় চাপানোর প্রবণতাই আসলে সমস্যার মূল।
আইনের কথা বলি। বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ (সংশোধিত ২০১৮) অনুযায়ী, শ্রমিকের কর্মস্থলে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা মালিকের বাধ্যতামূলক দায়িত্ব। আইনে স্পষ্টভাবে বলা আছে- ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিরাপত্তা সরঞ্জাম সরবরাহ, নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিতকরণ এবং দুর্ঘটনা প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ মালিক বা ঠিকাদারের দায়িত্ব। এই দায়িত্বে অবহেলার ফলে যদি শ্রমিক মারা যান, তবে সেটি কেবল “দুর্ঘটনা” নয়- আইনগত অবহেলা।
এছাড়া দণ্ডবিধি, ১৮৬০-এর ৩০৪ (ক) ধারা অনুযায়ী, অবহেলাজনিত কারণে কারও মৃত্যু ঘটলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা হতে পারে। অর্থাৎ, নিরাপত্তা ব্যবস্থা না রেখে কাজ করানো এবং তার ফলে শ্রমিকের মৃত্যু হলে মালিক, ঠিকাদার বা দায়িত্বপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক আইনের চোখে দায়ী।
তবু বাস্তবে কী হয়? বেশিরভাগ ক্ষেত্রে একটি জিডি, কখনো সামান্য ক্ষতিপূরণ, আর তারপর দায়মুক্তি। শ্রমিকের পরিবার পায় না ন্যায়বিচার, পায় না স্থায়ী সুরক্ষা। কারণ তারা দরিদ্র, অশিক্ষিত এবং আইনি লড়াই চালানোর ক্ষমতাহীন। আইনে ক্ষতিপূরণের কথাও বলা আছে। শ্রম আইন অনুযায়ী, কর্মস্থলে দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলে শ্রমিকের পরিবার ক্ষতিপূরণ পাওয়ার অধিকার রাখে। কিন্তু এই ক্ষতিপূরণ আদায়ের প্রক্রিয়া জটিল, দীর্ঘ এবং প্রভাবশালীদের জন্য সহজে এড়ানো সম্ভব। ফলে অনেক পরিবার আইনের পথেই যায় না।
এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দায় রাষ্ট্রের। নির্মাণ খাতে নিরাপত্তা তদারকির জন্য সরকারি সংস্থা থাকলেও তাদের কার্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধ। কতগুলো নির্মাণস্থলে নিয়মিত পরিদর্শন হয়? কতজন মালিককে নিরাপত্তা না মানার জন্য শাস্তি দেওয়া হয়? বাস্তব চিত্র হতাশাজনক।
নির্মাণ শ্রমিকের জীবন কি তবে সস্তা? তারা কি শুধুই উন্নয়নের বলি? চকচকে ভবন, উড়ালসড়ক আর মেগা প্রকল্পের পেছনে যে রক্ত ঝরে, তার হিসাব কি রাষ্ট্র রাখে?
দায় শুধু মালিক বা ঠিকাদারের নয়- দায় রাষ্ট্রেরও। আইন প্রয়োগে ব্যর্থতা, দুর্বল তদারকি, এবং মৃত্যুকে “দুর্ঘটনা” বলে চালিয়ে দেওয়ার সংস্কৃতিই এই মৃত্যুগুলোকে স্বাভাবিক করে তুলেছে।
এখন সময় এসেছে স্পষ্ট অবস্থান নেওয়ার। নির্মাণ শ্রমিকের মৃত্যু মানেই একটি ফৌজদারি তদন্ত হওয়া উচিত। নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়া কাজ করানোকে গুরুতর অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। ক্ষতিপূরণকে দয়া নয়, অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ- শ্রমিকের জীবনকে উন্নয়নের খরচ হিসেবে মেনে নেওয়ার মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
একটি রাষ্ট্রের উন্নয়ন তখনই টেকসই হয়, যখন সেই উন্নয়নের ভিত রক্তে ভেজা নয়, ন্যায়ে প্রতিষ্ঠিত। নির্মাণ শ্রমিকের মৃত্যু কোনো অনিবার্য নিয়তি নয়- এটি আমাদের অবহেলা, দায়হীনতা ও নীরবতার ফল।
প্রশ্ন একটাই- আর কত প্রাণ গেলে আমরা বলব, এবার যথেষ্ট?
লেখক : হাফিজুর রহমান খান, মানবাধিকার কর্মী
বিকেপি/এমবি

