অন্যের পরিচয়ে ডিজিটাল প্রতারণা : প্রযুক্তির আড়ালে অপরাধ, নীরব শিকার সমাজ
আইন ও আদালত ডেস্ক
প্রকাশ: ২৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১:২৮
ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার পথে আমরা দ্রুত এগিয়ে চলেছি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, মোবাইল ব্যাংকিং, অনলাইন শিক্ষা ও ই-কমার্স আমাদের জীবনকে সহজ করেছে। কিন্তু এই অগ্রগতির ছায়ায় বেড়ে উঠছে এক ভয়ংকর অপরাধ- অন্যের নাম, ছবি ও পরিচয় ব্যবহার করে ডিজিটাল প্রতারণা। এই অপরাধ শুধু আর্থিক ক্ষতিই নয়, ব্যক্তিগত মর্যাদা, মানসিক নিরাপত্তা ও সামাজিক বিশ্বাসকে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ইমেইল কিংবা ভুয়া ওয়েবসাইট- সবখানেই আজ পরিচয় চুরির মহোৎসব চলছে। কারও নাম ও ছবি ব্যবহার করে ভুয়া আইডি খুলে টাকা হাতিয়ে নেওয়া, মানহানি করা, সম্পর্ক নষ্ট করা কিংবা ব্ল্যাকমেইল করা, এসব এখন নিত্যদিনের ঘটনা। প্রশ্ন হলো, আইনে এর শাস্তি কী? এবং সেই আইন কি বাস্তবে ভুক্তভোগীকে সুরক্ষা দিতে পারছে? বাংলাদেশের আইনে অন্যের পরিচয়ে প্রতারণা একটি স্পষ্ট অপরাধ।
দণ্ডবিধি, ১৮৬০-এর ৪১৯ ধারা অনুযায়ী, ব্যক্তি সেজে প্রতারণা করলে সর্বোচ্চ ৩ বছর কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হতে পারে। আর যদি প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ বা সম্পদ হাতিয়ে নেওয়া হয়, তবে ৪২০ ধারায় সর্বোচ্চ ৭ বছর কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে। ডিজিটাল মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধের ক্ষেত্রে আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩ (যা আগের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে প্রতিস্থাপন করেছে)। এই আইনে ভুয়া পরিচয় ব্যবহার, ডিজিটাল প্রতারণা, অননুমোদিতভাবে অন্যের তথ্য ব্যবহার, এবং প্রতারণার মাধ্যমে ক্ষতি সাধনের জন্য কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড, উভয়ের বিধান রয়েছে। অর্থাৎ, ফেসবুক বা অনলাইনে অন্যের নাম-ছবি ব্যবহার করে প্রতারণা করাও সরাসরি ফৌজদারি অপরাধ।
কাগজে-কলমে আইন যথেষ্ট কঠোর হলেও বাস্তবতা ভিন্ন। অধিকাংশ ভুক্তভোগী জানেনই না- এই অপরাধের বিরুদ্ধে মামলা করা যায়। বিশেষ করে নারী ও কিশোরীরা ভুয়া আইডি, মেসেজ ও হুমকির শিকার হলেও সামাজিক লজ্জা ও ভয়ের কারণে মুখ খুলতে পারেন না। ফলে অপরাধীরা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে।
ডিজিটাল প্রতারণার সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক হলো- এটি বিশ্বাসকে ভেঙে দেয়। যখন একজন মানুষ বুঝতে পারেন যে তার নাম ও ছবি ব্যবহার করে কেউ অন্যের সঙ্গে প্রতারণা করছে, তখন শুধু আইনি নয়, সামাজিকভাবেও তিনি ক্ষতিগ্রস্ত হন। বন্ধুত্ব, পারিবারিক সম্পর্ক, পেশাগত সম্মান, সবকিছুই প্রশ্নের মুখে পড়ে। এই ক্ষতির পরিমাণ টাকা দিয়ে মাপা যায় না। আরেকটি গুরুতর সমস্যা হলো আইন প্রয়োগের দুর্বলতা। মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া জটিল, তদন্ত ধীর, প্রযুক্তিগত দক্ষতার অভাব প্রকট। অনেক ক্ষেত্রে ভুয়া আইডি খোলা ব্যক্তি ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। ফলে আইনের ভয় কমে যায়, অপরাধ বাড়ে।
এখানে রাষ্ট্রের দায়িত্ব অস্বীকার করার সুযোগ নেই। ডিজিটাল অপরাধ দমনে শুধু আইন করলেই হবে না, তার কার্যকর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। সাইবার ক্রাইম ইউনিটকে আরও শক্তিশালী করা, থানায় ডিজিটাল অপরাধ বিষয়ে প্রশিক্ষিত কর্মকর্তা নিয়োগ এবং সহজ অভিযোগ ব্যবস্থার প্রয়োজন এখন সময়ের দাবি।
একই সঙ্গে নাগরিকদের সচেতনতাও অত্যন্ত জরুরি। অপরিচিত লিংকে কিদ্বক না করা, ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ার না করা, সন্দেহজনক আইডি রিপোর্ট করা- এসব অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। তবে সচেতনতার দায় শুধু নাগরিকের নয়; রাষ্ট্রকেও স্পষ্ট বার্তা দিতে হবে যে, ডিজিটাল জগৎ কোনো আইনশূন্য এলাকা নয়। বিশেষ করে অন্যের পরিচয়ে প্রতারণা করা অপরাধীদের জন্য কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা জরুরি। কারণ এটি শুধু একজন ব্যক্তিকে নয়, পুরো সমাজের ডিজিটাল নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলে।
প্রযুক্তি যেমন সুযোগ সৃষ্টি করেছে, তেমনি দায়িত্বও বাড়িয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ তখনই নিরাপদ হবে, যখন মানুষ নিশ্চিতভাবে জানবে—তার পরিচয় সুরক্ষিত, তার সম্মান আইন দ্বারা রক্ষিত। অন্যের নাম ও রূপ ধারণ করে প্রতারণা কোনো “চালাকি” নয়; এটি গুরুতর অপরাধ। আইনের কঠোর প্রয়োগ ও সামাজিক প্রতিরোধ ছাড়া এই অপরাধ বন্ধ হবে না। প্রযুক্তির অগ্রযাত্রা থামানো যাবে না, কিন্তু অপরাধের লাগাম ধরা রাষ্ট্রেরই দায়িত্ব। এখনই সময় ডিজিটাল প্রতারণার বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা দেখানোর।
বিকেপি/এমবি

