Logo

আইন ও বিচার

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পদত্যাগের ঘোষণা

আইন, বাস্তবতা ও বাংলাদেশের রাজনীতি

Icon

মাসুম আহম্মেদ

প্রকাশ: ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮:২৬

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পদত্যাগের ঘোষণা

ডিজিটাল যুগে রাজনীতি আর কেবল দলীয় কার্যালয়, সংবাদ সম্মেলন বা সংসদের মেঝেতেই সীমাবদ্ধ নেই। ফেসবুক পোস্ট, ইউটিউব ভিডিও বা লাইভ বক্তব্য- এসবই এখন রাজনৈতিক বার্তা পৌঁছানোর প্রধান মাধ্যম। এই বাস্তবতায় সাম্প্রতিক সময়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন সামনে এসেছে: সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘোষণা দিয়ে কোনো রাজনৈতিক পদ থেকে পদত্যাগ করা আইনত কতটা বৈধ?

বিশেষ করে, যদি আদালতের এফিডেভিট বা আনুষ্ঠানিক নথির মাধ্যমে তা না করা হয়, তাহলে বাংলাদেশের আইনি কাঠামোতে এর গ্রহণযোগ্যতা কোথায় দাঁড়ায়?

পদত্যাগ: রাজনৈতিক না আইনগত বিষয়?

প্রথমেই একটি মৌলিক পার্থক্য স্পষ্ট করা জরুরি- সব পদত্যাগ এক ধরনের নয়। রাজনৈতিক পদত্যাগ মূলত দুই রকমের হতে পারে: ১. দলীয় পদ (যেমন: সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, সদস্য), ২. সংবিধিবদ্ধ বা রাষ্ট্রীয় পদ (যেমন: সংসদ সদস্য, মন্ত্রী, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানপ্রধান)

দলীয় পদত্যাগ অনেকাংশেই দলের নিজস্ব গঠনতন্ত্র ও অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলার বিষয়। অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় বা সাংবিধানিক পদত্যাগ সরাসরি আইন, সংবিধান ও বিধিমালার সঙ্গে যুক্ত।

দেশের বিদ্যমান আইনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া কোনো ঘোষণাকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে আইনি দলিল হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় না। তবে এটিও সত্য যে আইন এখন আর কাগজ-কলমেই সীমাবদ্ধ নয়। আদালত ও প্রশাসন বাস্তবতা বিবেচনায় অনেক সময় বক্তব্যের উদ্দেশ্য, স্পষ্টতা ও প্রমাণযোগ্যতাকে গুরুত্ব দেয়।

কিন্তু এখানেই মূল সমস্যা- ফেসবুক পোস্ট বা ভিডিও: স্বাক্ষরিত নয়, যাচাইযোগ্য আনুষ্ঠানিক নথি নয়, মুছে ফেলা বা সম্পাদনা করা যায়, হ্যাক বা ভুয়া দাবির ঝুঁকি থাকে। এই কারণে আদালত বা নির্বাচন কমিশনের মতো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান সাধারণত লিখিত, স্বাক্ষরিত ও আনুষ্ঠানিকভাবে দাখিলকৃত পদত্যাগপত্র ছাড়া কোনো পদত্যাগ কার্যকর বলে গণ্য করে না।

এফিডেভিটের ভূমিকা : বাধ্যতামূলক না সহায়ক?

এফিডেভিট মানে শপথনামা, যা নোটারি বা আদালতের মাধ্যমে সত্যতা নিশ্চিত করা হয়। প্রশ্ন হলো, পদত্যাগের ক্ষেত্রে এফিডেভিট কি বাধ্যতামূলক?

উত্তর হলো: সব ক্ষেত্রে না।

দলীয় পদত্যাগে সাধারণত এফিডেভিট বাধ্যতামূলক নয়। দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী লিখিত পদত্যাগপত্র দিলেই যথেষ্ট হতে পারে।

রাষ্ট্রীয় বা সাংবিধানিক পদে (যেমন সংসদ সদস্য) ক্ষেত্রে লিখিত ও আনুষ্ঠানিক পদত্যাগ অপরিহার্য। এখানে এফিডেভিট সরাসরি বাধ্যতামূলক না হলেও, অনেক সময় আইনি জটিলতা এড়াতে এটি ব্যবহার করা হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘোষণা এ ক্ষেত্রে কেবল একটি রাজনৈতিক বক্তব্য, আইনি প্রক্রিয়ার বিকল্প নয়।

বর্তমান বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট: রাজনীতি ও নাটকীয়তা 

বাংলাদেশের রাজনীতিতে সাম্প্রতিক আমরা লক্ষ্য করছি- পদত্যাগ এখন অনেক সময় প্রতীকী ও চাপ সৃষ্টির কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আবেগঘন ঘোষণা দিয়ে রাজনৈতিক বার্তা দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হচ্ছে না।

এর ফলে তৈরি হচ্ছে কয়েকটি সমস্যা: ১. আইনি বিভ্রান্তি- আদৌ পদত্যাগ কার্যকর হয়েছে কি না, ২. প্রশাসনিক অচলাবস্থা- সংশ্লিষ্ট পদ শূন্য কি না তা নিয়ে দ্বিধা, ৩. জনগণের বিভ্রান্তি- রাজনৈতিক নাটক আর বাস্তবতার পার্থক্য অস্পষ্ট, ৪. আইনের প্রতি অবজ্ঞা- প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর বাইরে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা।

একজন রাজনীতিবিদ ফেসবুকে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়ে পরদিন দলে সক্রিয় থাকলে, সেটি শুধু হাস্যকরই নয়, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্যও ক্ষতিকর।

আদালতের দৃষ্টিভঙ্গি: উদ্দেশ্য নয়, প্রক্রিয়া

বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা সাধারণত ‘ইচ্ছা’ (intention) নয়, ‘আইনি প্রক্রিয়া’ (procedure)- কে প্রাধান্য দেয়। কেউ পদত্যাগ করতে চেয়েছেন, এটি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তিনি কীভাবে করেছেন, সেটিই নির্ধারণ করে আইনি বৈধতা।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া ঘোষণা আদালতে সর্বোচ্চ সহায়ক প্রমাণ হতে পারে, চূড়ান্ত দলিল নয়। আদালত প্রশ্ন করবে: লিখিত পদত্যাগপত্র কোথায়?

কর্তৃপক্ষ তা গ্রহণ করেছে কি না? সংবিধান বা গঠনতন্ত্র অনুযায়ী প্রক্রিয়া মানা হয়েছে কি না?

এই প্রশ্নগুলোর উত্তর না থাকলে ফেসবুক পোস্টের কোনো আইনি মূল্য থাকে না।

গণতন্ত্রের জন্য কোন পথটি জরুরি?

গণতন্ত্র শুধু মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর দাঁড়িয়ে নেই; এটি দাঁড়িয়ে আছে প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলা ও আইনের শাসনের ওপর। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম রাজনীতিকে গতিশীল করেছে, এটি ইতিবাচক। কিন্তু এটিকে যদি আইনি প্রক্রিয়ার বিকল্প বানানো হয়, তাহলে রাষ্ট্র দুর্বল হয়।

দেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পদত্যাগের ঘোষণা একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক বার্তা হতে পারে, কিন্তু তা আইনগতভাবে সম্পূর্ণ নয়। 

আদালতের এফিডেভিট বা অন্তত আনুষ্ঠানিক লিখিত প্রক্রিয়া অনুসরণ না করলে এমন পদত্যাগ রাষ্ট্রীয় বা সাংবিধানিক ক্ষেত্রে কার্যকর হয় না।

রাজনীতিকে নাটক থেকে বের করে এনে প্রাতিষ্ঠানিক ধারায় ফেরানো এখন সময়ের দাবি। অন্যথায়, আমরা এমন এক রাজনীতির দিকে এগোব, যেখানে ফেসবুক পোস্টই হবে আইন- আর সেটিই হবে গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় পরাজয়।

বিকেপি/এনএ

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

আইনি প্রশ্ন ও উত্তর আইন ও আদালত

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর