আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলা ও ভোক্তা অধিকার: আইন মানার বিকল্প নেই
সোহানা ইয়াসমিন
প্রকাশ: ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮:৩৪
আগামী ১ জানুয়ারি থেকে রাজধানীর অদূরে পূর্বাচল শুরু হচ্ছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা। এ মেলা বাংলাদেশের অর্থনীতি, শিল্প ও সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রদর্শনী। দেশি-বিদেশি পণ্যের সমাহার, উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহণ এবং সাধারণ মানুষের ব্যাপক আগ্রহ, সব মিলিয়ে এই মেলা একটি উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি করে।
তবে দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, প্রতি বছর এই আনন্দঘন আয়োজনের আড়ালে ভোক্তা অধিকার লঙ্ঘনের নানা অভিযোগ উঠে আসে। বিশেষ করে পণ্যের অতিরিক্ত মূল্য নির্ধারণ, মূল্যতালিকা না থাকা, মানহীন পণ্য বিক্রি এবং প্রতারণামূলক অফার এসব বিষয় মেলার মূল উদ্দেশ্যকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে।
ভোক্তা অধিকার আইন: কাগজে নয়, বাস্তবে প্রয়োগ জরুরি
বাংলাদেশে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ একটি সুস্পষ্ট ও শক্তিশালী আইন। এই আইনে বলা হয়েছে-
পণ্যের গায়ে বা দোকানে মূল্যতালিকা স্পষ্টভাবে প্রদর্শন করতে হবে। নির্ধারিত মূল্যের বেশি দামে পণ্য বিক্রি করা যাবে না। ভেজাল, মেয়াদোত্তীর্ণ বা প্রতারণামূলক পণ্য বিক্রি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ভোক্তাকে প্রতারণা করলে জরিমানা ও কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। তবু প্রশ্ন থেকে যায়, এই আইন আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় কতটা কার্যকরভাবে মানা হচ্ছে?
বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, অনেক স্টলে একই পণ্যের ভিন্ন ভিন্ন দাম, কোথাও মূল্যতালিকা নেই, আবার কোথাও ‘মেলা উপলক্ষে বিশেষ মূল্য’ দেখিয়ে অস্বাভাবিকভাবে বেশি দাম নেওয়া হচ্ছে।
মেলার পরিবেশ, ভিড় ও উৎসবমুখরতার সুযোগ নিয়ে কিছু বিক্রেতা ভোক্তাদের দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছেন, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার অন্যতম লক্ষ্য হলো ন্যায্যমূল্যে পণ্য বিপণন এবং ভোক্তার আস্থা অর্জন। সেখানে যদি অতিরিক্ত দামে পণ্য বিক্রি করা হয়, তবে তা শুধু ভোক্তার সঙ্গে প্রতারণা নয়, বরং সৎ ব্যবসায়ীদের প্রতিও অবিচার।
অতিরিক্ত দামের ফলে, সাধারণ ভোক্তা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন, মেলার প্রতি মানুষের আস্থা কমে যায়, ভবিষ্যতে ক্রেতা উপস্থিতি হ্রাস পায়, আন্তর্জাতিক পরিসরে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়। একটি আন্তর্জাতিক মানের মেলায় এ ধরনের অনিয়ম কোনোভাবেই শোভন নয়। প্রশাসনের ভূমিকা, নজরদারি ও শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
মেলার আয়োজক কর্তৃপক্ষ, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর এবং সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের সমন্বিত ভূমিকা এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শুধু উদ্বোধনের দিন উপস্থিতি দেখিয়ে দায়িত্ব শেষ করলে চলবে না। প্রয়োজন নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত ও মনিটরিং টিম, প্রতিটি স্টলে মূল্যতালিকা বাধ্যতামূলকভাবে টানানো, অভিযোগ গ্রহণের জন্য সহজ ও দৃশ্যমান ব্যবস্থা, প্রমাণিত অভিযোগে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। আইন প্রয়োগ দৃশ্যমান না হলে অনিয়ম থামে না- এটাই বাস্তবতা।
এক্ষেত্রে ভোক্তার দায়িত্বও কম নয়। ভোক্তা অধিকার রক্ষায় শুধু প্রশাসন নয়, ভোক্তাদেরও সচেতন ভূমিকা পালন করতে হবে। অনেক সময় আমরা নিজেরাই আইন ভাঙার সুযোগ তৈরি করে দিই। ভোক্তাদের উচিত দাম জিজ্ঞেস করে ও মূল্যতালিকা দেখে পণ্য কেনা, অযৌক্তিক বেশি দাম দেখলে প্রতিবাদ করা, রসিদ সংগ্রহ করা, প্রয়োজনে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে অভিযোগ করা।
নীরবতা প্রতারণাকে উৎসাহিত করে- এই সত্য ভুলে গেলে চলবে না।
সৎ ব্যবসা কখনো লোকসানের কারণ হয় না। যারা মেলায় অংশগ্রহণ করছেন, তাদের মনে রাখা জরুরি- একটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা শুধু বিক্রির জায়গা নয়, এটি বিশ্বাস ও সুনাম গড়ার ক্ষেত্র।
অতিরিক্ত মুনাফার আশায় ভোক্তাকে ঠকালে হয়তো সাময়িক লাভ হবে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে তা ব্যবসার জন্য ক্ষতিকর। বরং ন্যায্য দাম, মানসম্মত পণ্য ও ভালো ব্যবহারই পারে একজন ক্রেতাকে আজীবনের গ্রাহকে পরিণত করতে।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা সফল হবে তখনই, যখন সেখানে ভোক্তা অধিকার আইন পূর্ণাঙ্গভাবে মানা হবে। অতিরিক্ত দামে পণ্য বিক্রি করে মেলার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, আয়োজক, ব্যবসায়ী এবং ভোক্তা- সবার সম্মিলিত দায়িত্বেই এই মেলা হতে পারে সত্যিকারের আন্তর্জাতিক মানের।
আইন মানা কোনো অনুগ্রহ নয়, এটি বাধ্যবাধকতা। আর সেই বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করাই হোক আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার সবচেয়ে বড় সাফল্য।
বিকেপি/এনএ

