Logo

আইন ও বিচার

ফ্রিল্যান্সিংয়ে প্রতারণা

স্বপ্ন বিক্রির আইনি প্রতিকার কোথায়?

Icon

বায়েজিদ তাশরীক

প্রকাশ: ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮:৪২

স্বপ্ন বিক্রির আইনি প্রতিকার কোথায়?

ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্নের সঙ্গে যে কয়েকটি শব্দ আজ ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে, তার একটি হলো ফ্রিল্যান্সিং। তরুণদের কর্মসংস্থান, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন এবং আত্মনির্ভরতার সম্ভাবনা- সব মিলিয়ে ফ্রিল্যান্সিং আজ একটি আশাবাদের নাম। কিন্তু এই আশার আড়ালেই ক্রমশ বাড়ছে এক ভয়ংকর বাস্তবতা- ফ্রিল্যান্সিংয়ের নামে প্রতারণা।

সোশ্যাল মিডিয়া, ইউটিউব বিজ্ঞাপন কিংবা মেসেজিং অ্যাপে প্রতিদিনই চোখে পড়ছে এমন প্রলোভন:

  • ‘ঘরে বসে মাসে ৫০ হাজার টাকা’,
  • ‘কোনো দক্ষতা লাগবে না’,
  • ‘১০০% নিশ্চিত আয়’,
  • ‘আগে টাকা দিন, পরে কাজ’।

এই প্রতিশ্রুতির ফাঁদে পড়ে প্রতারিত হচ্ছেন হাজারো তরুণ, শিক্ষার্থী ও বেকার মানুষ। প্রশ্ন হলো, এ ধরনের প্রতারণার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের আইনে প্রতিকার কী? রাষ্ট্র কি যথেষ্ট প্রস্তুত?

প্রতারণার নতুন রূপ: ফ্রিল্যান্সিংয়ের ছদ্মবেশ :

বর্তমানে যে ধরনের প্রতারণা সবচেয়ে বেশি দেখা যাচ্ছে, সেগুলো হলো প্রশিক্ষণের নামে প্রতারণা, ভুয়া প্রতিষ্ঠান খুলে অতিরিক্ত ফি নেওয়া, কিন্তু কোনো বাস্তব দক্ষতা বা কাজ না দেওয়া,

কাজ দেওয়ার নামে আগাম টাকা আদায়: ‘আইডি খোলার ফি’, ‘সিকিউরিটি মানি’, ‘সফটওয়্যার চার্জ’,

ভুয়া মার্কেটপ্লেস ওয়েবসাইট, যেখানে কাজ দেখিয়ে শেষে টাকা না দেওয়া, ডিজিটাল পনজি স্কিম, অন্যকে যুক্ত করলে কমিশন কিন্তু শেষ পর্যন্ত সবকিছু ভেঙে পড়ে।

আইডি হ্যাক ও ডেটা চুরি

ফ্রিল্যান্সিং, অ্যাকাউন্ট দখল করে আয় আত্মসাৎ।

এই প্রতারণার সবচেয়ে বড় শিকার হচ্ছেন গ্রামাঞ্চলের তরুণরা, যারা প্রযুক্তি সম্পর্কে সীমিত ধারণা রাখেন এবং দ্রুত আয়ের আশায় ঝুঁকি নেন।

অনেকেই মনে করেন, অনলাইনে হওয়া এসব প্রতারণার বিরুদ্ধে আইন কার্যকর নয়। বাস্তবে এটি পুরোপুরি সত্য নয়। বাংলাদেশের বিদ্যমান আইনি কাঠামোতে ফ্রিল্যান্সিং সংক্রান্ত প্রতারণা মোকাবিলার জন্য একাধিক আইন রয়েছে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮

এই আইনের আওতায় অনলাইনে প্রতারণা, মিথ্যা তথ্য দিয়ে অর্থ আত্মসাৎ, ভুয়া ওয়েবসাইট বা অ্যাকাউন্ট ব্যবহার, এসব অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়। গুরুতর ক্ষেত্রে কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে। 

যদিও এই আইন নিয়ে মতভেদ আছে, তবু অনলাইন প্রতারণা দমনে এটি একটি কার্যকর হাতিয়ার হতে পারে।

দণ্ডবিধি, ১৮৬০ : বাংলাদেশের প্রচলিত দণ্ডবিধিতেও প্রতারণার বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট বিধান রয়েছে ধারা ৪১৫-৪২০: প্রতারণা ও প্রতারণার মাধ্যমে সম্পত্তি আত্মসাৎ, ধারা ৪০৬-৪০৯: বিশ্বাসভঙ্গ।

ফ্রিল্যান্সিংয়ের নামে টাকা নিয়ে কাজ না দেওয়া বা ভুয়া প্রতিশ্রæতি দেওয়া স্পষ্টভাবে এসব ধারার আওতাভুক্ত।

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ :

যেখানে ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণ বা ডিজিটাল সেবা বাণিজ্যিকভাবে বিক্রি করা হচ্ছে, সেখানে ভোক্তা অধিকার আইনও প্রযোজ্য। মিথ্যা বিজ্ঞাপন, প্রতারণামূলক অফার বা সেবা না দেওয়ার অভিযোগে জরিমানা, লাইসেন্স বাতিল, ক্ষতিপূরণ দেয়ার সুযোগ রয়েছে।

অর্থপাচার ও মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সেবার অপব্যবহার 

অনেক প্রতারণায় বিকাশ, নগদ বা অন্যান্য মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবহার করা হয়। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা ও মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন অনুযায়ী তদন্তের সুযোগ আছে। কিন্তু বাস্তবে এই নজরদারি এখনও দুর্বল।

আইন থাকা সত্ত্বেও প্রতারণা কেন বাড়ছে?

আইন সম্পর্কে অজ্ঞতা, ভুক্তভোগীরা জানেন না কোথায় অভিযোগ করবেন। ভয় ও লজ্জা- প্রতারিত হওয়ার কথা অনেকে প্রকাশ করতে চান না। প্রশাসনিক ধীরগতি- 

সাইবার অপরাধ তদন্তে দক্ষতার অভাব, প্রতারণার ডিজিটাল রূপ- অপরাধীরা দ্রুত আইডি ও প্ল্যাটফর্ম বদলে ফেলে। ফলে প্রতারকরা প্রায়শই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়।

ফ্রিল্যান্সিং বাংলাদেশের জন্য একটি সম্ভাবনাময় খাত। একে প্রতারণামুক্ত রাখতে রাষ্ট্রকে কিছু জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে। ভুয়া প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান ও অনলাইন পেজের বিরুদ্ধে নিয়মিত সাইবার অভিযান, অনুমোদিত ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণ, প্রতিষ্ঠানের রেজিস্ট্রেশন ও তালিকা প্রকাশ, সহজ অভিযোগ ব্যবস্থাপনা ও দ্রুত তদন্ত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যমে ডিজিটাল, সচেতনতা কর্মসূচি। আইন প্রয়োগ দৃশ্যমান না হলে প্রতারণা কমবে না।

প্রতারিত হওয়া অপরাধ নয়, কিন্তু প্রতারণাকে প্রশ্রয় দেওয়া অপরাধকে শক্তিশালী করে। তাই নাগরিকদের উচিত- 

  • ‘সহজ ও নিশ্চিত আয়’ প্রলোভনে না পড়া
  • আগাম টাকা দেয়ার আগে যাচাই করা
  • রসিদ, স্ক্রিনশট ও লেনদেনের প্রমাণ রাখা
  • প্রতারণার শিকার হলে অভিযোগ করা
  • সচেতন নাগরিকই পারে প্রতারকের সবচেয়ে বড় শত্রু হতে।

ফ্রিল্যান্সিং বাংলাদেশের তরুণ সমাজের জন্য একটি বাস্তব সম্ভাবনা। কিন্তু সেই সম্ভাবনাকে ব্যবহার করে প্রতারণা চালানো শুধু ব্যক্তিগত ক্ষতিই নয়, জাতীয় অর্থনীতির জন্যও হুমকি। 

দেশের আইনে এই প্রতারণার প্রতিকার আছে-সমস্যা আইনের অভাবে নয়, কার্যকর প্রয়োগের অভাবে।

স্বপ্ন বিক্রির নামে প্রতারণা বন্ধ করতে হলে রাষ্ট্র, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, গণমাধ্যম এবং নাগরিক- সবার সম্মিলিত উদ্যোগ দরকার। নইলে ফ্রিল্যান্সিংয়ের নামে এই প্রতারণা একদিন আস্থার সবচেয়ে বড় শত্রুতে পরিণত হবে।

বিকেপি/এনএ

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

আইনি প্রশ্ন ও উত্তর আইন ও আদালত

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর