শত্রু সম্পত্তি ও অর্পিত সম্পত্তি আইনের নামে দীর্ঘস্থায়ী অবিচার
অ্যাড. শহীদুল্লাহ মিয়া
প্রকাশ: ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮:৫০
দেশের ভূমি ও সম্পত্তি ব্যবস্থাপনায় ‘শত্রু সম্পত্তি’ ও ‘অর্পিত সম্পত্তি’ এক জটিল ও সংবেদনশীল অধ্যায়। এটি কেবল একটি আইনি ধারণা নয়; বরং লাখো নাগরিকের নাগরিক অধিকার, উত্তরাধিকার ও ন্যায়বিচারের প্রশ্নের সঙ্গে জড়িত। স্বাধীনতার পাঁচ দশক পেরিয়েও এই ইস্যু পুরোপুরি নিষ্পত্তি না হওয়া রাষ্ট্রের জন্য একটি বিব্রতকর বাস্তবতা।
শত্রু সম্পত্তি আইনের উৎপত্তি ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় প্রণীত Enemy Property Act, ১৯৬৫ থেকে। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার যুদ্ধকালীন নিরাপত্তার অজুহাতে যেসব নাগরিককে ‘শত্রু রাষ্ট্রে অবস্থানকারী’ বা ‘শত্রুর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট’ হিসেবে বিবেচনা করেছিল, তাদের সম্পত্তি রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে নেয়। বাস্তবে এই আইন প্রধানত পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রয়োগ হয়, যারা দেশত্যাগ না করলেও কেবল ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে সম্পত্তির অধিকার হারান।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর স্বাভাবিক প্রত্যাশা ছিল এই বৈষম্যমূলক আইন বাতিল হবে। কিন্তু বাস্তবে ১৯৭৪ সালে কেবল নাম পরিবর্তন করে ‘শত্রু সম্পত্তি’কে ‘অর্পিত সম্পত্তি’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। আইনের ভাষা বদলালেও মূল কাঠামো ও প্রভাব একই থেকে যায়। ফলে এক ধরনের যুদ্ধকালীন আইন স্বাধীন রাষ্ট্রেও বহাল থাকে।
বর্তমানে অর্পিত সম্পত্তি সংক্রান্ত প্রধান আইন হলো অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন, ২০০১, যা ২০১১ ও ২০১৩ সালে সংশোধিত হয়। এই আইনের উদ্দেশ্য ছিল ভুলভাবে তালিকাভুক্ত সম্পত্তি প্রকৃত মালিক বা তাদের উত্তরাধিকারীদের কাছে ফেরত দেওয়া। আইনে আবেদন, যাচাই-বাছাই ও প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রত্যর্পণের বিধান রাখা হয়েছে। তবে বাস্তব চিত্র ভিন্ন।
বহু ক্ষেত্রে অর্পিত সম্পত্তির তালিকা ত্রুটিপূর্ণ, আবেদন নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা রয়েছে, এবং প্রভাবশালী মহলের দখলদারিত্ব বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক প্রকৃত মালিক প্রয়োজনীয় দলিল হারানোর কারণে অথবা প্রশাসনিক হয়রানির শিকার হয়ে সম্পত্তি ফিরে পাচ্ছেন না। ফলে আইন থাকা সত্ত্বেও ন্যায়বিচার অধরাই থেকে যাচ্ছে।
এই প্রেক্ষাপটে সংবিধানিক প্রশ্নও সামনে আসে। বাংলাদেশের সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে আইনের দৃষ্টিতে সমতা এবং ৪২ অনুচ্ছেদে সম্পত্তির অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। সেখানে কেবল অতীত রাজনৈতিক বাস্তবতা বা ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে নাগরিকদের সম্পত্তি রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে রাখা সংবিধানের মৌলিক চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
অর্পিত সম্পত্তি ব্যবস্থার আরেকটি বড় সমস্যা হলো দুর্নীতি। অনেক ক্ষেত্রে সম্পত্তি দেখভাল বা ব্যবস্থাপনার নামে তা বেহাত হয়ে গেছে। প্রকৃত মালিকরা আদালত ও প্রশাসনের দ্বারে দ্বারে ঘুরলেও দখলদাররা বহাল তবিয়তে ভোগ করছেন। এতে শুধু ব্যক্তিগত ক্ষতি নয়, রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকের আস্থাও ক্ষুণ্ন হচ্ছে।
এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও কার্যকর প্রশাসনিক উদ্যোগ। অর্পিত সম্পত্তির একটি হালনাগাদ ও স্বচ্ছ ডিজিটাল তালিকা, দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল, এবং দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ অপরিহার্য। পাশাপাশি প্রকৃত মালিকদের জন্য প্রক্রিয়াকে সহজ ও মানবিক করতে হবে।
শত্রু সম্পত্তি থেকে অর্পিত সম্পত্তির ইতিহাস বাংলাদেশের জন্য একটি শিক্ষা- আইনের নামে অন্যায় কত দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। এই অধ্যায়ের ন্যায়সঙ্গত নিষ্পত্তি মানে শুধু জমি বা ঘর ফেরত দেওয়া নয়; এটি সংবিধান, নাগরিক অধিকার এবং রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব রক্ষার প্রশ্ন। স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে এই ঐতিহাসিক বোঝা নামিয়ে রাখাই এখন সময়ের দাবি।
বিকেপি/এনএ

