ঘন কুয়াশায় নৌ-দুর্ঘটনা: দায় কার?
নৌপথে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার সময় এখনই
মাসুম আহম্মেদ
প্রকাশ: ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮:৩৩
বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। সড়ক ও রেলপথের পাশাপাশি নৌপথ এ দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ । প্রতিদিন হাজারো মানুষ লঞ্চ, ফেরি ও অন্যান্য নৌযানে করে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাতায়াত করে। কিন্তু শীত মৌসুম এলেই ঘন কুয়াশা নৌপরিবহন ব্যবস্থাকে মারাত্মক ঝুঁকির মুখে ফেলে দেয়। প্রায় প্রতি বছরই ঘন কুয়াশায় লঞ্চ ও নৌযান সংঘর্ষ, ডুবে যাওয়া কিংবা যাত্রী মৃত্যুর খবর সংবাদমাধ্যমে উঠে আসে। প্রশ্ন হলো- এই দুর্ঘটনার দায় কার, আর দায়িত্বই বা কে কতটা পালন করছে?
ঘন কুয়াশা একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলেও দুর্ঘটনা সব সময় প্রাকৃতিক কারণে ঘটে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, অবহেলা, অদক্ষতা, নিয়ম লঙ্ঘন এবং তদারকির ঘাটতির কারণে দুর্ঘটনা প্রাণঘাতী রূপ নেয়। ফলে দায়- দায়িত্বের প্রশ্নটি শুধু নৌযানের চালক বা মাস্টারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না; এর সঙ্গে জড়িত মালিকপক্ষ, নৌকর্তৃপক্ষ, প্রশাসন এবং এমনকি যাত্রীদের ভূমিকাও।
প্রথমত, নৌযানের চালক বা মাস্টারের দায়িত্ব সর্বাগ্রে আসে। ঘন কুয়াশায় দৃষ্টিসীমা কমে যাওয়া একটি সুপরিচিত ঝুঁকি। এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক ও জাতীয় নৌচলাচল বিধি অনুযায়ী গতি কমানো, রাডার ও নেভিগেশন যন্ত্র ব্যবহার, হর্ন বা সিগন্যাল বাজানো এবং প্রয়োজনে যাত্রা স্থগিত করা চালকের পেশাগত দায়িত্ব। কিন্তু বাস্তবতায় দেখা যায়, সময় বাঁচানো, অতিরিক্ত ট্রিপ দেওয়া কিংবা মালিকপক্ষের চাপের কারণে অনেক চালক ঝুঁকি নিয়েই লঞ্চ চালান। এই ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্তই অনেক সময় শত শত যাত্রীর জীবন বিপন্ন করে তোলে ।
দ্বিতীয়ত, লঞ্চ ও নৌযানের মালিকপক্ষের দায়িত্ব এড়ানোর সুযোগ নেই । অনেক নৌযানে এখনো আধুনিক রাডার, জিপিএস, অটোমেটিক আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম (AIS) কিংবা পর্যাপ্ত সেফটি ইকুইপমেন্ট নেই । আবার যেগুলো আছে, সেগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ যথাযথভাবে করা হয় না। ঘন কুয়াশার সময় যাত্রা সীমিত রাখার সরকারি নির্দেশনা থাকলেও লাভের আশায় অনেক মালিক তা উপেক্ষা করেন। যাত্রী বোঝাই করে ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রা চালু রাখাই প্রমাণ করে যে, ব্যবসায়িক স্বার্থ অনেক সময় মানুষের জীবনের চেয়েও বড় হয়ে ওঠে।
তৃতীয়ত, নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসনের দায়িত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কাজ হলো নৌপথের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, কুয়াশার সময় সতর্কতা জারি করা, প্রয়োজনে নৌযান চলাচল সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা এবং নিয়ম ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া । কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, নির্দেশনা জারি হলেও তার কার্যকর বাস্তবায়ন অনেক সময় হয় না। দুর্ঘটনার পর তদন্ত কমিটি গঠিত হয়, সুপারিশ আসে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার খুব কম ক্ষেত্রেই দৃশ্যমান হয় ।
চতুর্থত, যাত্রীদেরও কিছু দায়িত্ব অস্বীকার করা যায় না। ঘন কুয়াশায় যাত্রা ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও অনেক যাত্রী তাড়াহুড়োর কারণে লঞ্চে উঠতে আগ্রহী হন । অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই হলে প্রতিবাদ না করা, লাইফ জ্যাকেট ব্যবহারে অনীহা কিংবা নিরাপত্তা নির্দেশনা উপেক্ষা করাও দুর্ঘটনার ক্ষতি বাড়িয়ে দেয়। সচেতন যাত্রী হলে অনেক ক্ষেত্রে চালক বা কর্তৃপক্ষের ওপর চাপ তৈরি করা সম্ভব, যা ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রা রোধে ভূমিকা রাখতে পারে।
আইনগত দিক থেকে দেখলে, ঘন কুয়াশায় নিয়ম ভেঙে নৌযান চালানো শাস্তিযোগ্য অপরাধ। নৌপরিবহন অধ্যাদেশ ও সংশ্লিষ্ট বিধিমালায় নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে এমন কর্মকাণ্ডের জন্য জরিমানা, লাইসেন্স বাতিল এমনকি কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। কিন্তু আইন থাকলেও তার প্রয়োগ দুর্বল হলে দুর্ঘটনা কমে না, এটাই বাংলাদেশের বাস্তবতা।
এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে কয়েকটি বিষয় জরুরি। প্রথমত, কুয়াশার সময় নৌযান চলাচলের বিষয়ে 'জিরো টলারেন্স' নীতি গ্রহণ করতে হবে। নির্দেশ অমান্য করলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, সব যাত্রীবাহী নৌযানে আধুনিক নেভিগেশন ও নিরাপত্তা সরঞ্জাম বাধ্যতামূলক করতে হবে এবং নিয়মিত ফিটনেস পরীক্ষা চালু রাখতে হবে। তৃতীয়ত, চালক ও ক্রুদের নিয়মিত প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে হবে, যাতে তারা ঝুঁকি মোকাবিলায় দক্ষ হন। চতুর্থত, যাত্রীদের মধ্যেও সচেতনতা বাড়াতে হবে-যাতে তারা ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রা প্রত্যাখ্যান করতে সাহস পান।
ঘন কুয়াশায় নৌদুর্ঘটনা কোনো অনিবার্য নিয়তি নয়; এটি মূলত দায়িত্বহীনতার ফল । চালক, মালিক, কর্তৃপক্ষ ও যাত্রীড়সবার সম্মিলিত দায়িত্ব পালনের মাধ্যমেই নৌপথে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব। মানুষের জীবন যেন আর অবহেলা ও অদক্ষতার বলি না হয়- এই প্রত্যাশা আমাদের সবার।
বিকেপি/এনএ

