-6811c7a24dfdf.jpg)
রাত দশটা। শহরের ক্লান্ত বাতাস আর হেডলাইটের নরম আলো মিলে যেন এক বিষণ্ন গান গাইছে। রাস্তার এক পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বাইকের ওপর বসে আছে এক ছেলে। ছেলেটির চোখ মোবাইল স্ক্রিনে, কিন্তু মনটা আটকে আছে অন্য এক গল্পে, অন্য এক রাতে।
হঠাৎই সামনে দিয়ে হেঁটে যেতে দেখে দুই চেনা মেয়েকে—প্রান্তি ও অন্তী।
এক লহমায় বুক ধক করে ওঠে তার। চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেই রবিবার রাত—যখন সে, তার ছোট বোন মেহেরিন, আর মেহেরিনের দুই বান্ধবী প্রান্তি-অন্তী মিলে এক রাতের জন্য পুরো ঢাকা শহরকে নিজেদের করে নিয়েছিল।
৩০০ ফিটে হাওয়ায় চুল উড়িয়েছিল তারা, মহাখালীতে থেমে হেসে পড়েছিল কিছু অদ্ভুত গল্পে, গুলশানে রাত ২টায় কাবাব খেয়েছিল হেসে হেসে, আর সব শেষে গুদারাঘাট লেকের পাড়ে বসে ছিল এমন করে, যেন ভোরটা আর আসবেই না।
সেই রাতের মাঝেই প্রান্তিকে দেখে তার ভেতরটা নড়ে উঠেছিল। ভালো লেগে গিয়েছিল মেয়েটিকে—নির্বাক, অপ্রকাশ্য এক অনুভবে।
প্রান্তি ছিল যেন রাতের আকাশে নিঃশব্দে জ্বলে ওঠা একটি তারা—যার আলো চোখে পড়ে, কিন্তু ছুঁয়ে ফেলা যায় না।
তার হাঁটা ছিল গোধূলির সুরের মতো, হাসিটা ছিল যেন প্রথম বৃষ্টির পর গন্ধমাখা বাতাস। কথাগুলো ছিল ঝরনার মতো—নরম, স্বচ্ছ, কিন্তু গভীর। সে ছিল শুধু একটি মেয়ে নয়—একটি কবিতা, একটি অসমাপ্ত পঙ্ক্তি।
কিন্তু সেই রাতের পর, আর কথা হয়নি তাদের। কোনো মেসেজ, কোনো কল—সবকিছু থেমে গিয়েছিল এক রহস্যময় নীরবতায়।
আর আজ মঙ্গলবার, মাত্র দুদিন পর, হঠাৎ করে তারা সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। অস্থির হয়ে উঠে সে ডাকে—
‘এ...ই! এই যে...! প্রান্তি! এই শোনো না...!’
তার কণ্ঠ কেঁপে যায় উত্তেজনায়। মুখটা জ্বলে ওঠে আকাঙ্ক্ষায়। সে কয়েক কদম এগিয়ে যায়, মনের জোরে ডাকতে থাকে। কিন্তু মেয়েরা চলেই যায়... যেন কিছুই শুনছে না।
আসলে, তারা সত্যিই শোনেনি। হাতে ব্যস্ত ফোন, কানে হেডফোন, মন হয়তো অন্য গল্পে—তারা খেয়ালই করেনি, পেছনে কেউ একজন বারবার ডেকে উঠেছে স্মৃতির ভেতর থেকে।
ছেলেটি ভাবে, তারা উপেক্ষা করল তাকে। তার বুকটা হঠাৎ একটু ভারী হয়ে ওঠে—আরও কিছুটা এগিয়ে গিয়ে সে দেখে, প্রান্তি এক ছেলেকে দেখে হাত নাড়ছে, অন্তিও হাসছে।
তারা চলে যাচ্ছে নতুন কারো দিকে, আর সে দাঁড়িয়ে আছে পুরোনো এক রাতের পাশে।
চোখটা একটু ভিজে আসে। মনে হয়, রাতটাও আজ একটু বেশি নীরব।
সে ধীরে ধীরে ফিরে যায় তার বাইকের কাছে। সিটে বসে মোবাইলটা হাতে তোলে। আজ আর কিছু বলার নেই, শুধু অনুভবটাই জানিয়ে দিতে ইচ্ছে হয়।
তাই সে লিখে ফেলে—
‘প্রান্তি,
তোমরা বুঝতেও পারোনি, আজ আমি কতখানি সময় পেরিয়ে আবার সেই রবিবার রাতটায় ফিরে গিয়েছিলাম। আমি ডেকেছিলাম, প্রান্তি… বারবার। কিন্তু তোমরা শোনোনি।
হয়তো সত্যিই ব্যস্ত ছিলে, হয়তো শুনতে পাওনি। তবু আমি বিশ্বাস করতে চাই—তোমরা উপেক্ষা করোনি। কারণ আমি এখনও সেই গুদারাঘাটের শেষ বেঞ্চটার পাশে দাঁড়িয়ে আছি—যেখানে তোমরা হেসেছিলে শেষবারের মতো।’
এবার সে মেসেজটি পাঠিয়ে দেয় অন্তির ইনবক্সে। কারণ প্রান্তির ফোন নম্বর নেই তার কাছে।
মেসেজটি পাঠাবে কি না ভেবে নেয় না—কারণ এই গল্পটাও তো অসম্পূর্ণ ছিল, এটাও একটা চিঠির মতোই রয়ে গেল।
রাত দশটা পেরিয়ে যায়, কিন্তু কিছু ভালোবাসা ঠিক ওই সময়টাতেই আটকে থাকে— শুধু একবার তাকানোর অপেক্ষায়।
২৯ এপ্রিল ২০২৫, রাত ১১টা
- বাংলাদেশের খবরের জীবনানন্দ (সাহিত্য) বিভাগে লেখা পাঠান এই মেইলে- bksahitya247@gmail.com
এমএইচএস