Logo

জীবনানন্দ

যতদিন বাংলা ভাষা, ততদিন সত্যজিৎ রায়

মেহেদী হাসান শোয়েব

মেহেদী হাসান শোয়েব

প্রকাশ: ০২ মে ২০২৫, ১২:১০

যতদিন বাংলা ভাষা, ততদিন সত্যজিৎ রায়
বাংলা ভাষার প্রতি অগাধ ভালোবাসা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা—এই দুই বৈশিষ্ট্য সত্যজিৎ রায়কে অনন্য করে তুলেছিল। তাঁর সৃষ্টির মাধ্যমে বাংলা চলচ্চিত্র পেয়েছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, আর তিনি হয়ে উঠেছেন বাঙালির সাংস্কৃতিক দূত। 

সত্যজিতের এই ভাষাপ্রীতির সূচনা হয়েছিল নিজ পরিবারে—এক সাহিত্যনিষ্ঠ ঘর, যেখানে সাহিত্যের আলোয় আলোকিত ছিলেন তাঁর পিতা সুকুমার রায় এবং মাতা সুপ্রভা রায়। ছোটবেলায়ই বাংলা ছড়া, গল্প, আর সাহিত্য-আলোচনায় বেড়ে ওঠা সত্যজিৎ রায়ের মনে বাংলা ভাষা হয়ে ওঠে এক অন্তর্গত চেতনা। তাঁর শিক্ষাজীবনে রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্র ও উপেন্দ্রকিশোরের রচনার সঙ্গে পরিচয় তাঁর ভাষার প্রতি প্রেমকে আরও পোক্ত করে।

তাঁর চলচ্চিত্রে বাংলা ভাষা কখনো শুধুই সংলাপের বাহন ছিল না; ছিল চরিত্রের মনস্তত্ত্ব প্রকাশের মাধ্যম। যেমন, পথের পাঁচালী–তে অপু যখন দিদিকে জিজ্ঞেস করে, “দিদি, আমি বড় হয়ে কী হমু?”, সেই প্রশ্নে ধরা পড়ে ভাষার সরলতা ও গভীর মানবিকতা। আবার চারুলতা–তে দেখা যায় শিক্ষিত নারীর সংযত, পরিমিত ভাষা, যা পরিপ্রেক্ষিত অনুযায়ী রূপ নিয়েছে।

সত্যজিতের চলচ্চিত্রে ভাষার ব্যঙ্গ ও রাজনৈতিক বোধও অসাধারণ। হীরক রাজার দেশে ছবিতে ছড়ার মাধ্যমে ভাষাকে সামাজিক প্রতিবাদের অস্ত্র করেছেন। ‘যায় যদি যাক প্রাণ, হীরকের রাজা ভগবান’—এই সংলাপে যেমন হাস্যরস, তেমনি গভীর রাজনৈতিক বক্তব্য নিহিত।

শুধু চলচ্চিত্র নয়, সাহিত্যেও তিনি বাংলা ভাষার সম্ভাবনা প্রসারিত করেছেন। ফেলুদা ও প্রফেসর শঙ্কু সিরিজের মাধ্যমে তিনি বাংলা ভাষায় যুক্তিবাদ, বিজ্ঞানমনস্কতা ও রসবোধ একত্রে তুলে ধরেছেন। এই লেখাগুলোতে কথ্যভাষার সরলতা, যুক্তির বিশ্লেষণ এবং ভাষাশৈলীর পরিচ্ছন্নতা বাংলা সাহিত্যের নতুন মাত্রা সৃষ্টি করে।

গ্রাফিক ডিজাইন আধুনিক যোগাযোগের একটি অন্যতম শক্তিশালী মাধ্যম, যার মাধ্যমে ভাষা ও চিত্র একত্রে মিলে তথ্য, ধারণা ও অনুভূতি প্রকাশ করে। এই ডিজাইনের জগতে বাংলা ভাষার চর্চা নিছক ফন্ট বা টাইপফেস ব্যবহারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি বাংলা ভাষার ভিজ্যুয়াল রূপ, ঐতিহ্য, নান্দনিকতা ও পরিচিতিকে তুলে ধরার একটি সৃজনশীল প্রক্রিয়া। আধুনিক সময়ে ডিজিটাল মাধ্যমে বাংলা ভাষার দৃষ্টিনন্দন ও কার্যকর উপস্থাপন যেমন প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে, তেমনি এই মাধ্যমটি বাংলা ভাষাকে এক নতুন দিগন্তে পৌঁছে দেওয়ার পথও খুলে দিয়েছে।

বাংলা হরফের নিজস্ব সৌন্দর্য, গোলাকার বাঁক, আড়াল-উপাড়াল ও ক্যালিগ্রাফির ছন্দময়তা অন্য যেকোনো ভাষার তুলনায় আলাদা। এই বৈশিষ্ট্যগুলো ডিজাইনে যথাযথভাবে উপস্থাপন করতে পারলে তা কেবল নান্দনিক নয়। গ্রাফিক ডিজাইনার হিসেবেও সত্যজিৎ বাংলা ভাষার ভিজ্যুয়াল রূপায়ণে ছিলেন পথিকৃৎ। তিনি নিজেই বইয়ের প্রচ্ছদ, টাইপ ডিজাইন, পোস্টার, এবং পত্রিকার বিন্যাস করতেন—যেখানে বাংলা হরফকে সুনিপুণভাবে ব্যবহার করে এক স্বতন্ত্র ভিজ্যুয়াল ভাষা তৈরি করেছিলেন। ‘সন্দেশ’ পত্রিকার টাইপোগ্রাফি কিংবা তাঁর চলচ্চিত্রের পোস্টারে বাংলা ভাষার সৌন্দর্য এবং আধুনিকতা সমানভাবে ধরা পড়ে।

বাংলা ভাষার প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা শুধু শিল্পের মধ্যেই সীমিত ছিল না। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পল্টন ময়দানে তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন—


আমার রক্তে যে ভাষা বইছে, সে ভাষা বাংলা ভাষা।

এই উচ্চারণ বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতির প্রতি সত্যজিৎ রায়ের শ্রদ্ধা ও সংহতির প্রকাশ। বাংলাদেশ তখন সদ্য স্বাধীন; ভাষার জন্য রক্ত দেওয়া মানুষের দেশ তখন চিরকালীন বেদনার একুশে ফেব্রুয়ারিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মান জানাতে শুরু করেছে। ঠিক সেই প্রেক্ষাপটে একজন ভারতীয় বাঙালি শিল্পীর কণ্ঠে যখন এই কথাটি উচ্চারিত হয়, তা শুধু দুই বাংলার সংহতির প্রতীক হয়ে ওঠে না, বরং বাংলা ভাষাকে একটি সর্বজনীন সাংস্কৃতিক পরিচয়ে উত্তীর্ণ করে। তাঁর কণ্ঠে উচ্চারিত সেই বাক্য আজও ভাষাপ্রেমিক বাঙালির হৃদয়ে ধ্বনিত হয়—এই বিশ্বাস নিয়ে যে বাংলা ভাষা শুধু ভূগোলের বিষয় নয়, এটি রক্তের, হৃদয়ের, এবং চেতনার ভাষা। 

আজকের দিনে, যখন আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠার নামে মাতৃভাষাকে উপেক্ষা করার প্রবণতা বাড়ছে, তখন সত্যজিৎ রায় আমাদের শিখিয়ে যান—আন্তর্জাতিকতার আসল মানে নিজের শিকড়কে আঁকড়ে ধরেই বিশ্বমঞ্চে দাঁড়ানো।

সত্যজিৎ রায়ের সৃষ্টির প্রতিটি ফ্রেমে, প্রতিটি সংলাপে, প্রতিটি বাক্যে বাংলা ভাষা শুধু জীবন্ত নয়, সম্মানিত। তাঁর মাধ্যমে আমরা শিখি—ভাষা কেবল কথা নয়, এটি আত্মার প্রকাশ, বাংলা ভাষার শিল্প-সৌন্দর্য বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে দেওয়ার এক অবিনাশী প্রচেষ্টা।

বাংলা ভাষা যতদিন বেঁচে থাকবে, সত্যজিৎ রায় ততদিন আমাদের চেতনাতে জীবিত থাকবেন—ভাষার দূত হয়ে, শিল্পের প্রতিনিধি হয়ে। 

আজ তাঁর জন্মদিনে এই মহান শিল্পীকে শ্রদ্ধা জানাই। 

  • মেহেদী হাসান শোয়েব : লেখক, প্রকাশক, বিতার্কিক; শিফট ইনচার্জ, বাংলাদেশের খবর

বাংলাদেশের খবরের জীবনানন্দ (সাহিত্য) বিভাগে লেখা পাঠান এই মেইলে- bksahitya247@gmail.com

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর