
গ্রাফিক্স : বাংলাদেশের খবর
রবিবার, ঘড়ির কাঁটা ছুঁই ছুঁই করছে রাত বারোটা। কোলাহলমুখর ঢাকা শহর ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। অফিস শেষে আয়ান মাত্রই ফিরেছে বাসায়। ক্লান্ত শরীর, অবসন্ন চোখ। গোসল, খাওয়া-দাওয়া শেষ করে ঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ঠিক তখনই বাজে ফোন। ছোট বোন মেহেরিন।
—ভাইয়া, তুমি কই?
—বাসায়। ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছি।
—না ঘুমাতে হবে না। বের হও, ৩০০ ফিট ঘুরতে যাবো।
প্রথমে রাজি হয় না আয়ান। শরীরটা ক্লান্ত, চোখে ভাসছে ঘুম। তবে মেহেরিনের আব্দার আর আদুরে ধমক—‘তুমি না গেলে আড়ি’—এই কথাটুকুই যেন ভেঙে দেয় তার অবসন্নতার দেয়াল। শুধু একটি শর্তে রাজি হয় আয়ান—‘ঘোরাঘুরি শেষে তাড়াতাড়ি ফিরব। সকালে অফিস আছে।’
সাড়ে বারোটার দিকে আয়ান তার একমাত্র অবিচল সঙ্গী মোটরসাইকেল নিয়ে বাসা থেকে বের হয়। ঢাকার রাত্রিকালীন ঠাণ্ডা হাওয়ায় তার মুখ ছুঁয়ে যায় এক অদ্ভুত অনুভব। কে জানত, এই রাতে একটা নরম জ্যোৎস্না নামবে তার জীবনে?
৩০০ ফিটে গিয়ে মেহেরিনের সঙ্গে দেখা হয়।
সঙ্গে ছিল মেহেরিনের দুই বান্ধবী—প্রান্তি ও অন্তি।
প্রথম দেখাতেই আয়ানের চোখ আটকে যায় প্রান্তিতে।
প্রান্তি—চোখে স্বচ্ছতার দীপ্তি, মুখে শিশির পড়া সকালের মতো কোমলতা। চুলগুলো যেন রাতের হাওয়ায় গান গাইছিল। তাকে দেখে মনে হয়, সে শহরের কোলাহলে হারিয়ে যাওয়া একটুকরো নির্জনতা।
চারজন মিলে শুরু করে ঘোরাঘুরি। আয়ান তুলে নিতে থাকে একের পর এক ছবি। তার প্যাশন, তার চেনা রাস্তায় একমাত্র শিল্প ছিল ক্যামেরার চোখ।
প্রান্তির ছবি তুলতে তুলতে সে বারবার থমকে যায়। প্রতিটি ক্লিকে আয়ান যেন ধরে রাখতে চায় তার হাসি, চোখের চাহনি, চুপ থাকা আবেগ।
আর প্রান্তি? সে মুগ্ধ হয়ে বলে—‘আয়ান ভাইয়া, তুমি খুব সুন্দর করে ছবি তোলো।’
এই প্রশংসা শুনে আয়ান হেসে ওঠে। কিন্তু ভিতরে ভিতরে এক সুর বেজে ওঠে—প্রান্তি তার ছবিতে যতটা সুন্দর, বাস্তবে তার চেয়েও হাজার গুণ বেশি।
তারা ম্যাজিক নৌকায় ওঠে। আনন্দে আকাশ ছুঁতে থাকা মুহূর্তেই ঘটে ছোট্ট এক ঘটনা। প্রান্তি প্রচণ্ড ভয় পায়। ভয়ে শরীরের শেষ শক্তিটুকু দিয়ে চিৎকার করতে থাকে সে, যেন তাতে আতঙ্কটা একটু হলেও কমে। তার কাঁপা শরীর দেখে আয়ান নিজেই নিচে নামিয়ে আনে। মাথায় পানি ঢালে, হাত রাখে কাঁধে। সেই মুহূর্তটা আয়ানের হৃদয়ে গেঁথে যায়। সে বুঝতে পারে, ভালোবাসা শব্দে নয়—স্পর্শহীন যত্নেই প্রকাশ পায়।
তারপর মহাখালীতে ব্রাক ইউনিভার্সিটির পুরাতন ক্যাম্পাসের সামনে নির্ভার আড্ডা, মধ্যরাতে গুলশানে গিয়ে ধোঁয়া ওঠা কাবাবের স্বাদ, আর নির্জন রাস্তায় কিছু নিষ্পাপ হাসাহাসি—সব মিলিয়ে মনে হচ্ছিল, শহরটা শুধু ওদের জন্যই জেগে আছে।
রাতের শেষ প্রহরে তারা চলে যায় গুদারাঘাটে। লেকের ধারে একটি বেঞ্চে মেহেরিন আর অন্তি, আর পাশের বেঞ্চে নিঃশব্দে বসে থাকে আয়ান ও প্রান্তি। চারপাশ ঢেকে যায় নিস্তব্ধতায়—শুধু শোনা যায় হালকা বাতাসের ছোঁয়া আর পানির ঢেউয়ের মৃদু শব্দ, যেন শহরটাও ঘুমিয়ে পড়েছে।
আয়ান চুপচাপ তাকিয়ে থাকে প্রান্তির দিকে। সে বুঝে ফেলে—এই মেয়েটার মাঝে এমন কিছু আছে যা তাকে বারে বারে টানছে। কিন্তু সেই টানটুকু প্রকাশের সাহস তার হয় না।
ভোরের আলো ফুটে ওঠে। এক কাপ লাল চা হাতে প্রান্তি হেসে বলে— ‘রাতটা অনেক সুন্দর ছিল, তাই না?’
আয়ান হালকা মাথা নাড়ে। সে চায় বলতে—‘তুমি ছিলে বলেই রাতটা সুন্দর হয়েছে। তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি, প্রান্তি।’
কিন্তু কণ্ঠে আটকায় সব কথা।
সকালের আলো গাঢ় হলে বিদায় নেয় সবাই। প্রান্তি চলে যাওয়ার সময় আয়ানের দিকে তাকিয়ে হেসে হাত নাড়ে। সেই হাসি আয়ানের মনে জেগে রাখে এক অদ্ভুত আলো।
প্রান্তি জানে না, তার একটা হাসি, একটা ভয়—কারও হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে। প্রান্তির কাছে হয়তো এই রাত কেবলমাত্র একটি রাতই, কিন্তু আয়ানের কাছে তা হয়ে গেছে একটা গল্পের শুরু-যার নাম ‘এক রাতের আলো’।
০১ মে ২০২৫, রাত ৩টা
- বাংলাদেশের খবরের জীবনানন্দ (সাহিত্য) বিভাগে লেখা পাঠান এই মেইলে- bksahitya247@gmail.com
- এমএইচএস