Logo

জীবনানন্দ

আমাদের বাতিঘর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

Icon

মো. বদিউজ্জামান

প্রকাশ: ২৩ জুন ২০২৫, ১৯:৫৬

আমাদের বাতিঘর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

আধুনিক বাংলা সাহিত্যে মননশীল বা সৃজনশীল রচনার বড় অভাব রয়েছে। চিন্তাশীল রচনা তথা মননশীল সাহিত্যের অগ্রসর অন্যান্য শাখার তুলনায় আমরা পিছিয়ে। ইংরেজি, ফারসি বা অন্যান্য সাহিত্যে সৃজনশীলতা ও মননশীলতা—উভয় ক্ষেত্রেই ব্যাপক সমৃদ্ধি দেখা যায়। সে তুলনায় আমাদের প্রবন্ধসাহিত্য তেমন অগ্রসর নয়, যতটা সাহিত্যের অন্য শাখাগুলোতে হয়েছে। বিশেষ করে মৌলিক মননশীল সাহিত্যিকের বড় অভাব রয়েছে। এই অভাবের সময়ে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এক দুর্লভ ও বরেণ্য সাহিত্যিক।

তিনি দীর্ঘদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন। সাহিত্যচর্চায় তিনি মূলত একজন প্রাবন্ধিক হলেও অনুবাদ, গল্প এবং উপন্যাস রচনায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি একাধিক পত্রিকার সম্পাদনায় যুক্ত ছিলেন, যেমন—‘পরিক্রমা’, ‘সাহিত্যপত্র’, ‘সচিত্র সময়’, ‘সাপ্তাহিক সময়’, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পত্রিকা’ ইত্যাদি। ১৯৮০-এর দশকে ‘গাছপাথর’ ছদ্মনামে তিনি দৈনিক সংবাদ–এ সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়ে সাপ্তাহিক কলাম লিখে খ্যাতি অর্জন করেন। বাংলা একাডেমি ১৯৭৬ সালে তাঁকে পুরস্কৃত করে এবং শিক্ষাক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য ১৯৯৬ সালে তিনি একুশে পদকে ভূষিত হন।

তাঁর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা হলো, তিনি প্রায় দুই দশক ধরে ‘নতুন দিগন্ত’ নামক একটি ত্রৈমাসিক পত্রিকা সাফল্যের সঙ্গে সম্পাদনা করে আসছেন। এই ত্রৈমাসিকের সম্পাদকীয় কলামে তিনি রাষ্ট্র, সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি ও দর্শনের মতো জটিল বিষয়গুলো সাধারণ পাঠকের জন্য সহজ ও সাবলীল ভাষায় উপস্থাপন করেন। তিনি একজন দক্ষ সংগঠক ও সমাজসচেতন মানুষ। সারাজীবন তিনি অন্যায় ও অসঙ্গতির বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকেছেন। সাহিত্যের ছাত্র হলেও তিনি কেবল সাহিত্যেই সীমাবদ্ধ থাকেননি—নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছেন সমাজ, রাষ্ট্র ও গণমানুষের মধ্যে।

তাঁর অনবদ্য রচনার মধ্যে রয়েছে বহু সৃষ্টিশীল প্রবন্ধ ও গবেষণামূলক গ্রন্থ। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে— নোরা তুমি যাবে কোথায়, উন্মুক্ত পথের স্বচ্ছন্দ যাত্রী, অবনতের আত্মোন্নতি, বেকনের মৌমাছিরা, সাম্যের ভয়, স্বাধীনতার স্পৃহা, দুই বাঙালির লাহোর যাত্রা, শিরোধার্য যত, কুসুম বন্ধন, অন্বেষা, দ্বিতীয় ভুবন, আমার পিতার মুখ, বঙ্কিমচন্দ্রের জমিদার ও কৃষক, শরৎচন্দ্র ও সামন্তবাদ, স্বাধীনতা ও সংস্কৃতি, একই সমতল, বৃত্তের ভাঙা গড়া, নেতা জনতা ও রাজনীতি, লেনিন কেন জরুরি, আপনজন প্রভৃতি।

ছোটগল্পের মধ্যে রয়েছে— ভালো মানুষের জগৎ, দরজাটা খোলা। উপন্যাসের মধ্যে আছে শেষ নেই, কনার অনিশ্চিত যাত্রা, বাবুলের বেড়ে ওঠা। অনুবাদ সাহিত্যেও রয়েছে তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি—অ্যারিস্টটলের কাব্যতত্ত্ব, ইবসেনের বুনো হাঁস, হাইজম্যানের কবিতার স্বভাব, হোমারের ওডিসি ইত্যাদি অনুবাদ তাঁর সাহিত্যকীর্তিকে করেছে আরও সমৃদ্ধ।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং বেগম রোকেয়ার মতো মনীষীদের নিয়েও তিনি অসাধারণ কিছু গ্রন্থ রচনা করেছেন। বিশেষত রবীন্দ্রনাথ কেন জরুরি বইটিতে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে তাঁর বিশ্লেষণমূলক প্রবন্ধ পাঠকের দৃষ্টিভঙ্গিতে নতুন মাত্রা যোগ করে। মুক্তচিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার ক্ষেত্রেও তিনি আমাদের পথপ্রদর্শক।

তাঁর জন্ম ১৯৩৬ সালে (তৎকালীন বিক্রমপুর, বর্তমান মুন্সিগঞ্জ জেলার শ্রীনগর উপজেলার বাড়ৈখালী গ্রামে)। আজ তাঁর ৯০তম জন্মবার্ষিকী। এই বরণীয় মনীষার প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধা। শতায়ু হোক তাঁর জীবন।

লেখক : প্রভাষক

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর