হুমায়ূন আহমেদ : আমাদের সাহিত্যের একান্ত ঘরবাড়ি
প্রকাশ: ১৯ জুলাই ২০২৫, ১৮:৫৯
-687b9eef9f766.jpg)
সাহিত্য কেবল শব্দের বিন্যাস নয়, আমাদের মনের গভীরতর আবেগ, প্রশ্ন, স্বপ্ন আর চিন্তার প্রতিধ্বনি মেলে সাহিত্যে। জীবনের শত বাস্তবতা যখন আমাদের ক্লান্ত করে, মানুষ দূরে সরিয়ে দেয়, চারপাশ কঠিন হয়ে ওঠে—তখন সাহিত্য হয়ে ওঠে নির্ভরতার এক আশ্রয়। সাহিত্যের চরিত্রগুলো কখনো আমাদের মতো করে আমাদের প্রতিনিধি হয়ে কথা বলে, তার ভাষায় আমরা খুঁজে পাই নিজের ছায়া। তাই সাহিত্য শুধু পাঠেই ফুরিয়ে যায় না, বরং এ যেন জীবনের বিকল্প বাসস্থান, যেখানে মানুষ খুঁজে পায় নিজেকে।
সাহিত্যিকদের মধ্যে এমন কেউ কেউ থাকেন, যারা হয়ে ওঠেন পাঠকের আপনজন—যাদের বইয়ের পাতা মানেই শৈশব-কৈশোরের আনন্দ, যাদের চরিত্র মানেই প্রথম ভালোবাসা, যাদের গল্প মানেই জীবনের ঘ্রাণ। হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন তেমনই একজন, যিনি কেবল লেখক ছিলেন না—তারচেয়ে অনেক বেশি কিছু, ছিলেন আমাদের সাহিত্যের একান্ত ঘরবাড়ি।
আমাদের সাহিত্যে অনেক বড় বড় লেখক এসেছেন, কেউ ছিলেন উচ্চশ্রেণির, কেউ দার্শনিক, কেউ বিপ্লবী। হুমায়ূন আহমেদ এসে গড়েছিলেন একটি ‘ঘরোয়া সাহিত্য’, যেখানে ঢুকলে পাওয়া যেত এক কাপ ধোঁয়া ওঠা চা, উষ্ণতামাখা ভালোবাসা, কিছু বিষণ্নতা, আর এক হৃদয়ের হাহাকার। তাঁর লেখার ঘ্রাণ বাগানের প্রিয় ফুল আর পুরনো সংরক্ষিত ডায়েরির মতো—চেনা, নিজস্ব, ঘরোয়া অথচ চিরনতুন।
১৯৭২ সালে ‘নন্দিত নরকে’ উপন্যাস দিয়ে যাত্রা শুরু করে হুমায়ূন আহমেদ একের পর এক উপন্যাস, ছোটগল্প, নাটক ও চলচ্চিত্রে উপহার দিয়েছেন এমনসব চরিত্র, যাদের আমরা ভুলতে পারি না। হিমু, মিসির আলি, বাকের ভাই, বকুল, রূপা—এরা কেউই কেবল কল্পনার চরিত্র ছিল না, ছিল আমাদের পাশের ঘরের মানুষ। কেউ আত্মীয়, কেউ বন্ধু, কেউ প্রেমিকা কিংবা না বলা ভালোবাসা।
তাঁর লেখার বিশেষত্ব ছিল সরলতা। কিন্তু এই সরলতার আড়ালে ছিল দারুণ এক জাদু। তিনি জানতেন—কীভাবে খুব সাদামাটা ভাষায় বলতে হয় সবচেয়ে গভীর কথা। যেটা আমাদের সমাজ, রাজনীতি, ধর্ম, ভালোবাসা বা নিঃসঙ্গতার জটিল প্রেক্ষাপটেও মানুষকে সহজ করে ভাবতে শেখায়।
হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসে ছিল রোদ-বৃষ্টির খেলা। যেখানে ভালোবাসা কখনো ফুল হয়ে ফুটেছে, আবার কখনো বিষণ্নতা হয়ে ঝরেছে। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন, অল্প কথায় অনেক কিছু বলা যায়। তাঁর লেখাতে প্রকাশিত হয়েছে, হাসির মাঝেও থাকতে পারে অশ্রুজলের গন্ধ।
তাঁর নাটক ও চলচ্চিত্রের ভূমিকাও সাহিত্যসমান গুরুত্বপূর্ণ। এইসব দিনরাত্রি, কোথাও কেউ নেই, আজ রবিবার, অয়োময়—এইসব নাটক কেবল টেলিভিশনের অনুষ্ঠান ছিল না, ছিল আমাদের পারিবারিক সন্ধ্যার আবেগ। তাঁর পরিচালিত শ্যামল ছায়া বা ঘেটুপুত্র কমলার মতো চলচ্চিত্রগুলো সমাজমনস্ক শিল্পচর্চার অনন্য দলিল।
হুমায়ূন আহমেদ অনেক সময় সমালোচিত হয়েছেন, অনেকেই তাঁর সাহিত্যকে হালকা বা জনপ্রিয়ধারার বলে পাশ কাটিয়ে গেছেন। কিন্তু সাহিত্যের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে দেওয়ায় তাঁর ভূমিকা অবিস্মরণীয়। সাহিত্যকে মানুষের আপন করে তুলতে পারার যে প্রবল ক্ষমতা তাঁর ছিল, সমকালে এমন আর কাউকে দেখা যায়নি। তিনি মানুষকে বইয়ের কাছে এনেছিলেন—স্বতঃস্ফূর্ত ভালোবাসা দিয়ে, বাধ্যবাধকতা দিয়ে নয়।
তিনি জানতেন, কীভাবে মানুষের মনের অলিগলি ঘুরে বেড়াতে হয়। জানতেন, কীভাবে একটি ছাপার অক্ষর হয়ে ওঠে কারও শৈশব, কারও প্রেম, কারও হারিয়ে যাওয়া দিন। সেই কারণেই তিনি শুধু লেখক নন, তিনি আমাদের চেনাজানা নিকটজন—যাঁর লেখার ভেতর দিয়ে ঘুরে দেখা যায় যেন নিজের ভেতরখানি।
২০১২ সালের ১৯ জুলাই, আমরা হারিয়েছি হুমায়ূন আহমেদকে। কিন্তু আসলে এখনো হারিয়ে যাননি তিনি। তাঁর লেখা, তাঁর সৃষ্টি চরিত্র, তাঁর সেই প্রিয় ডায়লগগুলো আজো ঘুরে বেড়ায় আমাদের জীবনে। কেউ যখন বলে—‘আমার কিছু ভালো লাগে না’, আমরা শুনতে পাই হিমুর গলা। কেউ যখন চোখে চশমা তুলে গভীরভাবে চিন্তা করে, আমাদের মনে পড়ে মিসির আলি।
হুমায়ূন আহমেদ নেই, কিন্তু তাঁর তৈরি করা সাহিত্যিক ঘরবাড়ি আজও আমাদের আশ্রয়। যখন পৃথিবীটা কঠিন হয়ে যায়, আমরা ফিরে যাই হিমুর পাগলামিতে, মিসির আলির বিশ্লেষণে, কিংবা সেই অদ্ভুত বাড়িতে যেখানে রাত নামার সঙ্গে সঙ্গে আলো জ্বলে ওঠে রহস্যের।
হুমায়ূন আহমেদ—এমন একজন লেখক যিনি হয়ে ওঠেন পাঠকের ঘরবাড়ির মতো, যেখানে মোহগ্রস্ত হয়ে কল্পবাস করে সহস্র স্বপ্নবিলাসি। যেখানে চোখ মেললে নিজের সঙ্গে দেখা হয়, ফিরে পাওয়া যায় সেই ফেলে আসা দিনগুলো, যেখানে বুক ভরে শ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকা যায়।
ভালো থাকুন ওপারে, প্রিয় লেখক। আপনার লেখা, আপনার সৃষ্টি আজও আমাদের হৃদয়ের সবচেয়ে নির্জন কোণের বাতি হয়ে আছে।
এমএইচএস