Logo

জীবনানন্দ

শুদ্ধতম নির্জনতার কবি জীবনানন্দ দাশ

Icon

মো. বদিউজ্জামান

প্রকাশ: ২২ অক্টোবর ২০২৫, ১১:২৭

শুদ্ধতম নির্জনতার কবি জীবনানন্দ দাশ

এআই দিয়ে তৈরি ছবি

রূপসী বাংলার কবি হিসেবে খ্যাত ত্রিশের দশকের শ্রেষ্ঠ কবি জীবনানন্দ দাশ। বাংলা ভাষার শুদ্ধতম এই কবি একাধারে ছিলেন শিক্ষাবিদ, গল্পকার, প্রাবন্ধিক ও কবি। জীবন জীবিকার জন্য তিনি অধ্যাপনাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করলেও বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে একজন প্রধান কবি হিসেবে তিনি স্থায়ী আসন লাভ করেন। তিনি পঞ্চপাণ্ডবদের মধ্যে অন্যতম। জীবনানন্দ দাশ রবীন্দ্রনাথের বলয় থেকে বের হয়ে নতুন এক ধারায় বাংলা সাহিত্যে এক অধ্যায়ের সূচনা করেন।

জীবনানন্দ দাশের পিতা সত্যানন্দ দাশও ছিলেন সাহিত্য ও সংস্কৃতিপ্রেমী। তাঁর মা কুসুমকুমারী দাশও ছিলেন কবি। বরিশালের কালি বাড়ি রোডে তাদের বসতবাড়ি। তাঁর পিতা সত্যানন্দ দাশ পেশায় শিক্ষক ছিলেন এবং বরিশালের ব্রজমোহন স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন।

পঞ্চপাণ্ডবদের রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার করার প্রবণতা কতখানি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তা বিচার্য নয়; তবে জীবনানন্দ নিজস্ব নির্মাণ ও নিজস্ব ভাষায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। তিনি সমাজ ও সমাজের বাস্তবতার সঙ্গে মুখোমুখি হয়ে নিজেকে সাজিয়ে নিয়েছেন। আর তিনি তাঁর অনুভূতি প্রকাশ করেছেন নিতান্ত ভিন্ন স্বরে। ‘সন্ধ্যা আসে শিশিরের শব্দের মতো’— এমন ইন্দ্রিয়বিপর্যয়ী শব্দসম্ভার তাঁর অনুভূতির বিচ্ছুরণ ঘটিয়েছে। সত্য, হেমন্তে কাঁঠালের পাতা হলুদ হয়ে ঝরে পড়ার শব্দ পঞ্চপাণ্ডবদের কেউ শোনেননি, এমনকি রবীন্দ্রনাথও না। কিন্তু জীবনানন্দ তা শুনেছেন। জীবনানন্দ জানতেন বিশ শতকের সভ্যতা ভেঙে খণ্ড খণ্ড হয়ে যাবে এবং অতীতে ভ্রমণ না করে নতুন স্বরে, নতুন ভ্রমণ শুরু করতে হবে।

১৯৩৩ সালের দিকে তিনি বেশ কিছু গল্প ও উপন্যাস লিখেছেন, কিছু সম্পূর্ণ, কিছু অসম্পূর্ণ। রূপসী বাংলার কবি হয়েও তিনি ‘মহাপৃথিবীর কবি’। তিনি দূরকে ও খুব নিকটকেও নিজের ভেতরে দেখতে পেয়েছেন। জীবনানন্দ ছিলেন ঘাস ও পাখি। রবীন্দ্রনাথের ফুল যেমন আকাশের উপরে থাকে, জীবনানন্দের পাখিরা আকাশ থেকে নেমে আসে এবং পরবর্তী জন্মে পাখি হয়ে পৃথিবীতে ফেরার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে। জীবনানন্দ আপ্লুত হয়েছিলেন অন্ধকার ও ধূসর জগতে, ঘাসের সম্রাজ্যে এবং বিদর্ভ নগরে। তাঁর অনন্ত অন্বেষার যাত্রা শেষ হয় রূপময়ী নাটোরে। শুধু নাটোরেই কবির এই যাত্রাবিরতি ঘটেছে, তবে কবির এই বিরতি দুটি দণ্ডের মতো।

শিল্পীমাত্রই যাত্রাপথের পথিক। জীবনানন্দও সুদূর অতীত থেকে যাত্রা শুরু করেছেন এক অধরা প্রেমিকার উদ্দেশ্যে। কবি হুটম্যানও শিল্পযাত্রার পথিক ছিলেন। তিনি নারী-বিবর্জিত, কোন প্রেমের কবিতা লিখেননি। চিরকুমার হুটম্যান প্রেমিক হিসেবে খ্যাতি পেয়েছিলেন। তবে হুটম্যানের যৌনতা বিদ্যমান ছিল; জীবনানন্দের রয়েছে ‘বউটি অব ফর্ম’ বা ‘ফর্ম অব বিউটি’। হাজার বছর পরে তিনি কোন একজনের কাছে ফিরে এসেছেন। সমুদ্রের তীর ধরে তিনি হেঁটে এসেছেন, অন্যদিকে অডিসিয়াস দেশে ফেরার জন্য অন্তহীন বাধা-বিপত্তির মধ্য দিয়ে সমুদ্রযাত্রা শুরু করেছিলেন।

কবি ইয়েটস জাহাজে সমুদ্রপথে পরিভ্রমণ করেছেন; জীবনানন্দ দাশ সমুদ্রের কিনার ধরে পায়ে হেঁটে। কবির এই পরিভ্রমণকে মানসিক ভ্রমণ বলা হয়। হাজার বছরের আয়ু নিয়ে হাজার বছরের পথ চলা সম্ভব নয়। বনলতা সেন কবিতায় এডগার অ্যালেন পো’র ‘To Helen’-এর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়, যদিও বলা হয়, কবি ইয়েটস-এর বহু কবিতা যেমন ‘Sailing to Byzantium’ জীবনানন্দকে প্রভাবিত করেছিল। কিটস যখন প্রৌঢ়, জীবনানন্দ তখন মাত্র তেতাল্লিশ।

ইয়েটস-এর কবিতায় যে অন্বেষণ, জীবনানন্দের অন্বেষণ তার মরীচিকা নেই। হাজার বছরের প্রবাহমানতা প্রকৃতপক্ষে কাব্যসত্য। ইয়েটস-এর ‘Sailing to Byzantium’ ও ‘On a Gracious Air’-এ তা স্পষ্ট।

গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যময় নিসর্গ ও রূপকথা-পুরাণ জীবনানন্দের কাব্যকে চিত্ররূপে গড়ে তুলেছে। এজন্য তিনি ‘রূপসী বাংলার কবি’ হিসেবে খ্যাত। বুদ্ধদেব বসু তাঁকে নির্জনতম কবি বলে আখ্যায়িত করেছেন। অন্যদিকে অন্নদাশঙ্কর রায় তাঁকে ‘শুদ্ধতম কবি’ বলে অভিহিত করেছেন। সমালোচকদের অনেকে তাঁকে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল পরবর্তী বাংলা সাহিত্যের প্রধান কবি মনে করেন। জীবনানন্দের ‘বনলতা সেন’ কাব্যগ্রন্থ নিখিলবঙ্গ রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য সম্মেলনে পুরস্কার পেয়েছিল (১৯৫৩)। ১৯৫৫ সালে ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ গ্রন্থটি ভারত সরকারের সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করে। জীবনানন্দ দাশের বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে রূপসী বাংলা, বনলতা সেন, মহাপৃথিবী, বেলা অবেলা কালবেলা, শ্রেষ্ঠ কবিতা ইত্যাদি।

জীবনানন্দ দাশ প্রধানত কবি হলেও বেশ কিছু প্রবন্ধ ও নিবন্ধও প্রকাশ করেছেন। ১৯৫৪ সালের মৃত্যুর পূর্বে তিনি ২১টি উপন্যাস ও ১২৮টি ছোটগল্প রচনা করেছিলেন, যার কোনটি তাঁর জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয়নি।

আজ জীবনানন্দ দাশের ৭১তম প্রয়াণ দিবস। আমাদের উচিত জীবনানন্দকে আরও গভীরভাবে পাঠ করা, কারণ তাঁর কবিতার আধুনিকতার ছোঁয়া বাংলা সাহিত্যে এক নতুন ধারার জন্ম দিয়েছে।

লেখক : শিক্ষক ও সংস্কৃতিকর্মী

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর