তপন বাগচী বাংলা সাহিত্যে এক পরিচিত সত্তা, যিনি শব্দের ভেতর দিয়ে দেখেন, শোনেন এবং অনুভব করেন সময়ের ধ্বনি। শব্দের কৃষক হয়ে যিনি চাষ করেন বোধের। তাই তাঁর কবিতা ও প্রবন্ধ উভয় ধারাতেই এক গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও সংবেদনশীলতার স্রোত প্রবাহিত হয়। তাঁর লেখার কেন্দ্রে থাকে মানুষ, তার বেদনা, তার জাগরণ, তার প্রতিরোধ এবং তার চিরন্তন সৌন্দর্যচেতনা।
তপন বাগচীর কবিতাকে বলা যেতে পারে তাঁর সমগ্র সাহিত্য-দর্শনের প্রতীকচিত্র। তিনি জানেন, সৃষ্টির আনন্দের পেছনে লুকিয়ে থাকে অজস্র বেদনা। কবি তপন বাগচী তাই লিখেছেন—
‘শুধুই তোমার নাম এঁকে যায় সময়ের দীর্ঘ চাতাল
আমাকে তাড়িয়ে ফেরে শিল্পের জরা
প্রাপ্তির বেশি বঁধু এতটা অধরা
সৃষ্টির মোহে কবি বেহেড মাতাল।’
কবির এই ‘বোধ’ কেবল ভালোবাসার নয়, এটি সময়ের সঙ্গে শিল্পীর সম্পর্কেরও ঘোষণা। তপন বাগচীর কবিতায় সময় হয়ে ওঠে জীবন্ত চরিত্র, যে কবির সঙ্গে বিতর্কে নামে, আবার তাঁকে বাঁচিয়েও রাখে।
বাগচীর ‘বোধঘুড়ি’ নামক কবিতায় আমরা দেখি, কল্পনা ও বোধ মিলে গড়ে তোলে এক আকাশযাত্রা। এখানে ঘুড়ি মানে শুধু আনন্দ বা খেলনা নয়, এটি জ্ঞানের, অনুভবের এবং সৃষ্টির প্রতীক। কবি লিখেছেন—
‘ছিঁড়ে যায় চিন্তাসূত্র, বোধের নাটাই খোঁজে মেঘের নিশানা…’
এখানে ‘ছিঁড়ে যাওয়া চিন্তাসূত্র’ তো তো সেই মানসিক টানাপোড়েন, যা সৃজনশীল মানুষকে চালিত করে। কবির কাছে আকাশ মানে মুক্তি।
তপন বাগচীর কবিতা কখনও নিছক প্রেম নয়, বরং প্রেমের মধ্যে দিয়ে তিনি অন্বেষণ করেন ‘অস্তিত্বের দূরত্ব’। ‘দূরত্ব-বন্দনা’ কবিতায় সেই দূরত্ব যেন এক ধরনের আধ্যাত্মিক সম্পর্কের ইঙ্গিত দেয়—
‘অত কাছে গিয়ে ফিরে আসি
শেষাবধি দূরত্বের জয়।’
এই ফিরে আসা কোনো পরাজয় নয়, বরং তা আত্মবোধের জয়। পৃথিবী-আকাশের মিলনের অসম্পূর্ণতা যেমন সৌন্দর্যের জন্ম দেয়, তেমনি মানুষের অসম্পূর্ণতাই শিল্পের জন্মভূমি।
‘কবিতার আঁতুড় ঘরে’তে তিনি লিখেছেন—
‘এই যে আমার গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা
এই যে আমার শহিদমিনার সাক্ষী রাখা
এই যে আমার নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে
রোজ নাগরিক ভোরের দেখা
সব কি শুধু জলের রঙে থাকবে লেখা?’
এখানে আমরা পাই এক নগরবাসীর অন্তর্গত স্মৃতি ও সংগ্রাম। শহর তাঁর কাছে কেবল বসবাসের স্থান নয়, বরং মানবিক চেতনার প্রতীক। শহরের ভেতরেই তিনি খুঁজে পান কবিতার জন্মস্থান। নাগরিক একঘেয়েমির ভেতর থেকে তিনি উদ্ধার করেন কবিতার বীজ।
‘আকাশ, পদ্মা ও চাঁদের যৌবন’ কবিতায় প্রকৃতি, প্রেম ও পৌরাণিক প্রতীক মিলেমিশে তৈরি করে এক স্বপ্নময় দৃশ্যপট। আকাশ, নদী, চাঁদ— সবই এখানে মানবিক রূপে কথা বলে। ‘ও পদ্মা, আমাকে নাইতে নেবে?’— এই প্রশ্নে আছে আত্মসমর্পণ, আবার একধরনের মুক্তির আকাঙ্ক্ষাও। তাঁর কবিতায় প্রকৃতি কখনো প্রেমিকা, কখনো দর্শন, কখনোবা এক অনন্ত প্রতীকের মূর্ত রূপ।
‘মামুলি’ কবিতায় মেনকা, মৈনাক, মলমাস— এই সব পুরাণপ্রসঙ্গ ব্যবহার করে বাগচী প্রেম, শরীর, ও নশ্বরতার চিরন্তন অন্বেষাকে নতুন রূপে প্রকাশ করেছেন। তাঁর পুরাণচেতনা বেকল অলংকার নয়, বরং আধুনিক মননের প্রতিফলন।
তপন বাগচীর কবিতা আমাদের বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করায়। অধিকারের দুরাবস্থা তুলে ধরে। ‘খোলাবাজার’ কবিতায় তিনি বলেন—
‘খোলাবাজারে বিক্রি হচ্ছে আমাদের অধিকার।’
এই পঙ্ক্তিটি এক ধাক্কায় সামাজিক চেতনায় আলোড়ন তোলে। তিনি এখানে কাব্যিক ব্যঞ্জনায় উচ্চারণ করেছেন সময়ের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শোষণের গল্প। ‘খনার বচন’, ‘খেপজাল’, ‘খিদে-মরা রাত’— সব মিলিয়ে এখানে ভাষা হয়ে উঠেছে প্রতিবাদের প্রতীক।
তপন বাগচীর কবিতা সহজ করে আমাদের সামনে তুলে ধরে জীবনের গভীরতম দার্শনিক প্রশ্ন। ‘চিরন্তনী’ কবিতায় তিনি বলেন—
‘সাগরের কাছে গেলে নদী আর নদীটি থাকে না
তবু তার আজন্ম ইচ্ছের ব্রত সমুদ্রসঙ্গম।’
এই রূপক যেন মানবজীবনের সারকথা। মৃত্যু অনিবার্য, কিন্তু তার মধ্য দিয়েই ঘটে জীবনের পূর্ণতা। এই ‘চিরন্তনী বোধ’ তপন বাগচীর সৃষ্টিজগতের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
কবিতার বাইরে প্রবন্ধ, গবেষণা ও জীবনীগ্রন্থ এমনকি উপন্যাসেও তপন বাগচী একই বোধকে প্রসারিত করেছেন। ‘বাংলাদেশের যাত্রাগান : জনমাধ্যম ও সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত’ কিংবা ‘লোকসংস্কৃতির কতিপয় পাঠ’ গ্রন্থে তাঁর বিশ্লেষণ শুধু তথ্যনির্ভর নয়, তা একান্ত মানবিকও। তিনি যাত্রাশিল্প, বাউলগান, প্রবাদ-প্রবচন, নারী-অংশগ্রহণ ইত্যাদি বিষয়ে লিখেছেন শেকড়সন্ধানী মমতায়। লোকজ সংস্কৃতির আলোয় তিনি দেখেছেন আধুনিক সমাজের ছায়া। তাঁর সৃজনকর্মের ভেতর দিয়ে তাই তিনি হয়ে ওঠেন ‘বোধের মহান শিল্পী’ এক।
তপন বাগচীর সাহিত্য আমাদের বোধের দরজায় কড়া নাড়ে। উপলব্ধি করায় মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতার দায়। তাঁর লেখায় যেমন ব্যক্তিগত অভিমান ও প্রেমের গোপন অনুরণন আছে, তেমনি আছে সময়, সমাজ, ও ইতিহাসের প্রতি গভীর প্রত্যয়। তিনি জানেন—
‘কথার মালা, মধুময় প্রিয় সঙ্গীত
কিছু পায় আলোছায়া, কিছু থাকে বোধের অতীত।’
এই ‘বোধের অতীত’ অঞ্চলেই তাঁর শিল্পের অবস্থান।
তপন বাগচীর সাহিত্য-ভুবন যেন এক অন্তহীন যাত্রা, যেখানে বেদনা ও সৌন্দর্য পাশাপাশি চলে। তাঁর কবিতা আমাদের শেখায় কীভাবে সময়ের ভিতর থেকেও অমর বোধকে চিনে নিতে হয়। তিনি সেইসব লেখকদের প্রতিনিধি, যারা ‘লোক’ ও ‘লোকোত্তর’-এর মাঝখানে দাঁড়িয়ে এক সেতুবন্ধন গড়ে তোলেন।
তপন বাগচী কেবল এক কবি নন, তিনি এক নিরন্তর অনুসন্ধানী মানুষ— যিনি ভাষার ভেতর দিয়ে খোঁজেন সৃষ্টির পরম তাৎপর্য। তিনি যেন এক দীর্ঘ ‘সাহিত্যযাপন’ করে চলেছেন।
প্রবন্ধ-গবেষণা, কবিতা, গল্প, গান, উপন্যাস— সাহিত্যের সকল শাখায় স্বকীয়তার চিহ্ন এঁকে দেওয়া এক সত্যিকারের সব্যসাচীর নাম তপন বাগচী। ১৯৬৮ সালের ২৩ অক্টোবর মাদারীপুরের কদমবাড়ি গ্রামে জন্ম নেওয়া এই গুণীজনকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাই।


