রাজধানীর আকাশে সেদিন সন্ধ্যার আলো নিভে আসছিল। গাবতলীর তৃতীয় কলোনির গলিটায় নরম বাতাসে ধুলোর গন্ধ মিশে ছিল, ছেলেপেলেরা রাস্তায় ক্রিকেট খেলছিল, আর সেই গলি ধরে ধীরে হাঁটছিল মধ্য বয়সি একটি মানুষ- মোতালেব। চোখের কোণে গভীর ক্লান্তি, মুখে এক ধরনের নিরুত্তাপ ভাব। ফ্ল্যাটে প্রবেশ করতেই ছোট মেয়ে রাইসা চিৎকার করে বলল- ‘বাবা এসেছো!’ মোতালেবের মুখে একচিলতে হাসি ফুটল, কিন্তু তা ছিল নিঃশব্দ। স্ত্রী নাসরিন তখন রান্নাঘরে, চুলার ধোঁয়ার ফাঁকে বলল- ‘আজও দেরি করেছ? অফিসে এত কাজ?’ মোতালেব একটু চুপ থেকে বলল- কাজ না, হিসাবটা মেলাতে সময় লাগল। হিসাব- শব্দটা নাসরিনের কানে কেমন লাগল যেন। সে কিছু না বলে শুধু তাকাল। সেই দৃষ্টিতে সন্দেহ, আবার করুণাও ছিল।
২. সময়টাকে যদি পেছনে নেওয়া যেত, তাহলে হয়তো দেখা যেত এক তরুণ- চোখে স্বপ্ন, হাতে বই, আর মুখে গ্রামের সহজ হাসি। সালটা ১৯৯৪। মোতালেব সদ্য এইচএসসি পাস করেছে স্থানীয় কলেজ থেকে। বাবা গফুর একজন গেরস্থ, মা নুরজাহান সংসার সামলান। ১৯৯৫ সালে সে ডিগ্রিতে ভর্তি হয়, কিন্তু মন টেকে না। বন্ধুরা সবাই চাকরির খোঁজে ঢাকা যাচ্ছে, কেউ টিউশন নিচ্ছে, কেউ দোকানে কাজ করছে, কেউ আবার সরকারি চাকরিও পেয়েছে। মোতালেবের ভিতরেও এক অস্থিরতা- আমিও কিছু করব। ১৯৯৮ সালে সে ঢাকায় আসে। মেস নেয় গাবতলীর কাছে। ঢাকা তখন তার কাছে এক বিস্ময়ের শহর- আলো, শব্দ, ভিড়, আর নানান রঙের মানুষ। মেসে আলতাফ আর সগীর নামে দুজনের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। আলতাফ ডিগ্রি পাস, টিউশনি করে। সগীর সরকারি কাজের ছোট ঠিকাদার। দুজনেই মোতালেবের মতো গ্রাম থেকে আসা। তবে তারা এখন শহুরে বাস করা মানুষের চেয়ে কয়েক ধাপ এগিয়ে। দারুণ চটপটে, আর তাদের গল্পগুলো যেন সিনেমা- নারী, টাকা, জীবন। একদিন আলতাফ বলেছিল- এই শহরে টিকে থাকতে হলে বুদ্ধি চাই, সাধু সেজে লাভ নেই। সগীর হেসে বলেছিল, মানুষের সুযোগ দেখেই মানুষ হয়, সুযোগ না পেলে মানুষ মানুষ থাকে না। মোতালেব সেই কথাগুলো মনে রেখেছিল।
৩. এক বছর পর, এক আত্মীয়ের মাধ্যমে তার বিয়ে হয় নাসরিন নামে এক মেয়ের সঙ্গে। নাসরিনের বাবার অবস্থা ভালো, নাসরিনের বাবার মাধ্যমেই মোতালেব চাকরি পায় এক গ্রুপ অব কোম্পানির গার্মেন্ট ডিভিশনে- সময়রক্ষক হিসেবে আশুলিয়ার জিরাবো এলাকায়। নতুন জীবনের শুরু। নাসরিন তখন আশা করে- এই মানুষটার সঙ্গে হয়তো নিরাপদ জীবন পাব। কিন্তু সে জানত না, মোতালেবের ভিতরে তখনো ঢাকার ধুলো লেগে থাকা সেই নেশাটা আছে- অল্পে পেতে চাওয়ার নেশা। একদিন সন্ধ্যায়, কাজ শেষে ফেরার পথে মোতালেবের দেখা হয় এক মেয়ের সঙ্গে- সাথী আক্তার। চেহারায় গ্রাম্য সরলতা, চোখে ভয়। সে কাজ খুঁজছে, কাঁধে ব্যাগ, হাতে কাগজপত্রের একটি ফোল্ডার। মোতালেব মেয়েটিকে লক্ষ্য করল। সে কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল- কিছু খুঁজছেন? - হ্যাঁ ভাই, ...একটা চাকরি খুঁজছি। - আচ্ছা, আমি দেখবো। কাল আমার অফিসে আসেন। পরদিন সে সাথীকে নিয়ে যায় বসের কাছে। সাথী নিয়োগ পায় কোয়ালিটি কন্ট্রোল ইন্সপেক্টর হিসেবে। এরপর থেকে সাথী আর মোতালেবের সম্পর্ক গাঢ় হয়। দুপুরে একসঙ্গে খাওয়া, বিকেলে চা, ছুটির দিনে সিনেমা। নাসরিনের প্রতি তার মনোযোগ কমে আসে। একদিন আলতাফকে পরিচয় করিয়ে দেয় সাথীর সঙ্গে। তারপর এক সপ্তাহ পরই দেখে- আলতাফ ও সাথী হাত ধরে হাঁটছে ফ্যান্টাসি কিংডমের সামনে। সেদিন রাতে মোতালেব বিছানায় শুয়ে থাকে নিঃশব্দে। নাসরিন জিজ্ঞেস করে, - মন খারাপ? মোতালেব শুধু বলে, - সবাই নিজের স্বার্থ দেখে, নাসরিন। কেউ কারও নয়।
৪. ২০০১ সালে তাদের ঘরে জন্ম নেয় প্রথম কন্যা মাহবুবা। ছোট্ট মেয়েটির মুখে হাসি দেখে মনে হয়েছিল, হয়তো সব অন্ধকার একদিন দূর হবে। কিন্তু বছর না ঘুরতেই মোতালেবের চাকরি চলে যায়। নতুন চাকরি মেলে এক কেমিক্যাল কোম্পানিতে, স্টোর কিপার হিসেবে। মোতালেব সেখানেও ছোট ছোট ‘হিসাব’ চালায়-বিলের টাকায় ঘাপলা, স্টক থেকে সামান্য মাল বেচা। স্ত্রী মাঝে মাঝে প্রশ্ন করে, তুমি কি সত্যিই ঠিক পথে আছো? মোতালেব ঝাঁঝিয়ে ওঠে,- এই শহরে ঠিক পথ বলে কিছু নেই, নাসরিন! সবাই কোনো না কোনোভাবে চুরি করে-সময়, বিশ্বাস, কিংবা মানুষ।
৫. ২০০৮ সালে বাবা অসুস্থ হন। হার্টের অসুখ, সঙ্গে ডায়াবেটিস। ভর্তি করানো হয় হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতালে। হার্টে তিনটি ব্লক ধরা পড়ে। চিকিৎসক বাইপাস সার্জারির পরামর্শ দেন। চিকিৎসার জন্য মোতালেব যা ছিল, সব বিক্রি করে বাইপাস সার্জারির ব্যবস্থা করে। কিন্তু সার্জারি কালে মোতালেবের বাবার আবার এটাক হয়, শেষ পর্যন্ত মোতালেব তার বাবাকে বাঁচাতে পারেনি। সেদিন রাতে বাবা চলে যাওয়ার পর মাটির দিকে তাকিয়ে বলেছিল, - বাবা, আমি ভালো মানুষ হতে পারিনি। তবু পরিবর্তন এলো না। বরং তার ভিতরের অন্ধকার আরও ঘন হলো।
৬. একদিন সগীরের মাধ্যমে পরিচয় হয় আলী নূর সাহেবের সঙ্গে। পঁয়তাল্লিশোর্ধ্ব ব্যবসায়ী, একজন রপ্তানিকারক। তিন রুমের অফিস, সম্মানজনক মানুষ, লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত কিন্তু সরল বিশ্বাসে ভরা। মোতালেব প্রায়ই তার অফিসে যেত। আলী নূর সাহেব কে ফ্রি পেলেই গল্প গুজব শুরু করে দিত মোতালেব। অফিস স্টাফ না থাকলে টুকটাক কাজ করে দিত। ব্যাংকে টাকা জমা দেওয়া, পার্টির কাছে স্যাম্পল পৌঁছে দেওয়া। কখনো কখন বাজার করা- এসব ছোটখাটো কাজ সে করত স্বতঃস্ফূর্তভাবে। আলী নূর ভাবতেন, মানুষ্টা বিশ্বস্ত, পরিশ্রমী। কিন্তু মোতালেব ভাবত, এই মানুষটা আমাকে বিশ্বাস করে, মানে আমিই তার দুর্বলতা জানি। একদিন জোহরের নামাজের সময় আলী নূর ড্রয়ারে টাকা রেখে অজু করতে যান। মোতালেব চুপিচুপি ড্রয়ার খুলে কয়েকটি নোট তুলে নেয়। ০অফিসের কর্মচারী কায়কোবাদ সেটা দেখে ফেলে, কিন্তু কিছু বলে না।কিছুদিন পর আবারও একই ঘটনা। আলী নূর টের পান, কিন্তু কারও দিকে আঙুল তুলতে পারেন না। অবশেষে এক বিকেলে, মোতালেব কফির কাপ হাতে বসে ছিল আলী নূরের সামনে। সে বলল, - স্যার, কফি বানিয়ে আনলাম। আলী নূর হেসে চুমুক দিলেন। কয়েক মিনিট পর তাঁর মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল। এরপর যা হলো, সেটি এক ঘন অন্ধকার অধ্যায়। অজ্ঞান অবস্থায় আলী নূর পড়ে রইলেন, আর মোতালেব ড্রয়ার খুলে ৩৭ হাজার টাকা নিয়ে বেরিয়ে গেল।
৭. পরদিন সকালেই খবরটি অফিসে ছড়িয়ে পড়ে। কায়কোবাদ ও জাকারিয়া ঘটনাটি জানায়। আলী নূর হতবাক হয়ে বললেন, - আমি বিশ্বাস করতে পারছি না, সে এমন করতে পারে! তবু তিনি মোতালেবকে কিছু বললেন না। একদিন মোতালেবকে ডেকে শুধু বললেন, আমি মানুষ কে বিশ্বাস করি, এটাই কি আমার দোষ, তুমি জানো আমি অনেকের সঙ্গে ব্যবসা করি, তাদের অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করি, কিন্তু তারা আমাকে প্রতারিত করেছে, আমি তাদের কিছু বলি না, কারণ আমি বিশ্বাস করি আল্লাহ কাউকে প্রতারিত করেন না, তিনি কাউকে ঠকান না, আল্লাহ না চাইলে কেহ ঠকে না, বরং যে ঠকায় সে এক সময় কঠিন বিপদে পড়ে। মোতালেব আলী নূর সাহবের কথাগুলো শুনে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। চোখে একফোঁটা পানি, যা লজ্জা না অনুতাপ- সে নিজেও জানে না।
৮. সময় গড়ায়। ২০২৫ সাল। গাবতলীর ছোট ফ্ল্যাটে এখনো সেই একই মানুষ- মোতালেব। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। বড় মেয়ে মাহবুবা এখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে, প্রতœতত্ত্ব পড়ছে; ছোট মেয়ে রাইসা মিশন স্কুলে ক্লাস থ্রিতে। নারী আসক্তি কমেছে, কিন্তু টাকা চুরির নেশা যায়নি। অফিসে কেউ কিছু হারালে সবাই তাকায় তার দিকে। সে মুখে অস্বীকার করে, কিন্তু মনে ভয়। এক রাতে মাহবুবা বাবার পাশে বসে বলল, - বাবা, আজ ক্লাসে স্যার বললেন নৈতিকতা মানে কী? তুমি বলো তো, নৈতিকতা কী? মোতালেব কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল- যা হারালে মানুষ হয়েও মানুষ থাকা যায় না, মা। মাহবুবা বিস্মিত চোখে তাকাল বাবার দিকে। সে দেখল, বাবার চোখ ভিজে গেছে।
৯. সেই রাতে মোতালেব বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। দূরে ধুলোমাখা বাতাসে বাসের আলো ঝলমল করছিল। তার মনে পড়ছিল আলী নূর সাহেবের মুখ, সাথীর চোখ, আলতাফের হাসি, আর নাসরিনের নীরব দৃষ্টি। হঠাৎ মনে হলো, সে একা নয়। এই শহরই যেন এক বিশাল মঞ্চ- যেখানে সবাই কোনো না কোনোভাবে চুরি করে। কেউ বিশ্বাস চুরি করে, কেউ সময়, কেউ সম্পর্ক। সে ফিসফিস করে বলল- আমি শুধু একটু বেশি করেছি, তাই আমি দোষী। ভিতরে থেকে নাসরিন ডেকে উঠল- চা দেব? মোতালেব হেসে বলল- না রে, আজ চা খেতে ইচ্ছে করছে না। মনে হয় ভিতরে একটু ঠান্ডা লাগছে। সে জানত না, সেই ঠান্ডা শুধু শরীরে নয়- মনেও জমে গেছে বহু বছরের অন্ধকার।
১০. ভোর রাতে ঘুমের মধ্যে নাসরিন শুনল এক মৃদু আওয়াজ- কেমন যেন হালকা শ্বাসের কষ্ট। জেগে দেখে, মোতালেব বারান্দায় বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখের নিচে কালচে দাগ, ঠোঁটে এক অস্পষ্ট হাসি। নাসরিন বলল, - ভিতরে চলো, ঠান্ডা লাগবে। - না, আমি ঠিক আছি। জানো, আমি আজ এক স্বপ্ন দেখেছি। - কী স্বপ্ন? - বাবা বলছে- তুমি এখনো বাঁচতে পারো, যদি চুরি করা বন্ধ করো। নাসরিন কিছু বলে না। শুধু চুপচাপ তার পাশে বসে। আকাশে তখন ফজরের আলো ফুটছে। কিছুক্ষণ পর মোতালেব নিঃশব্দে বলল- আমি আসলে চুরি করেছি শুধু টাকা না, তোমাদের আর আলী নূর সাহেবের মতো মানুষের বিশ্বাসও। নাসরিন ধীরে হাত রাখল তার কাঁধে। দূরে আজানের ধ্বনি উঠল। সেই মুহূর্তে, প্রথমবারের মতো মনে হলো- হয়তো তার ভিতরের অন্ধকারে একফোঁটা আলো ফুটছে...

