ছবি : এআই দিয়ে তৈরি
‘এমন জীবন করিবে গঠন, মরিলে হাসিবে তুমি, কাঁদিবে ভুবন’— নজরুলের এই উচ্চারণ আজ রক্তরেখায় মিলে যায় একটি নামের সঙ্গে— শরিফ ওসমান হাদি।
হাসতে হাসতে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে তুমি কাঁদিয়ে গেলে একটি জাতিকে। আজ স্তব্ধ বাংলার রাজপথ, নীরব প্রতিটি শহরের বাতাস, ভেজা চোখে তাকিয়ে আছে ইতিহাস।
তুমি জন্মেছিলে ঝালকাঠির নলছিটির মাটিতে, ১৯৯৩ সালের ৩০ জুন— এক মুসলিম ঘরে, যেখানে সম্পদ ছিল না পাহাড়সম, কিন্তু ছিল ঈমান, ছিল শিক্ষা, ছিল সংগ্রামের পাঠ।
টিনশেডের ছোট ঘরেই তোমার বেড়ে ওঠা। মাদরাসা শিক্ষক বাবার সাদা পাঞ্জাবির ভাঁজে ভাঁজে তুমি শিখেছিলে সততা, শিখেছিলে অন্যায়ের সামনে চুপ না থাকার সাহস।
মাওলানা আব্দুল হাদি ও তাসলিমা হাদির ছয় সন্তানের মধ্যে সবার ছোট তুমি— কিন্তু প্রতিবাদের কণ্ঠে সবচেয়ে উচ্চ।
শৈশব থেকেই অন্যায় দেখলে তোমার চোখ জ্বলে উঠত।
নলছিটি ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসায় শুরু হয় শিক্ষার পথ, ঝালকাঠি এন এস কামিল মাদরাসায় দাখিল-আলিম পেরিয়ে স্বপ্ন পৌঁছে যায় ঢাকায়।
প্রাচ্যের অক্সফোর্ডে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পাঠ নিতে নিতে তুমি বুঝে ফেলেছিলে— রাষ্ট্র মানে কেবল ক্ষমতা নয়, রাষ্ট্র মানে ইনসাফ, রাষ্ট্র মানে মানুষের অধিকার।
কলম হাতে নিলে তুমি হয়ে উঠলে সীমান্ত শরিফ। শব্দে শব্দে ভেঙে দিলে শোষণের দেয়াল, লিখলে নিপীড়নের বিরুদ্ধে, লিখলে আধিপত্যবাদের বিপরীতে।
‘লাভায় লালশাক পুবের আকাশ’— শুধু কবিতার বই নয়, ওটা ছিল একটি সময়ের প্রতিবাদী দলিল; রাজনৈতিক ফ্যাসিবাদের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদের নগ্ন মুখোশ।
তুমি শিক্ষক ছিলে— শ্রেণিকক্ষে ইংরেজির পাঠ, আর জীবনের পাঠে স্বাধীনতার ব্যাকরণ।
রামপুরার অলিগলিতে তুমি ছিলে সাধারণ মানুষের মতোই— কিন্তু দায়িত্বে অসাধারণ।
২০২৪-এর জুলাই— যখন রাজপথ জ্বলে উঠেছিল, তুমি দাঁড়িয়েছিলে সমন্বয়কের কাঁধে দায় নিয়ে, ছাত্র-জনতার পাশে ঢাল হয়ে।
তোমার প্রতিষ্ঠিত ইনকিলাব মঞ্চ— শুধু একটি প্ল্যাটফর্ম নয়, একটি স্বপ্নের নাম, যার লক্ষ্য ছিল সব আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ইনসাফভিত্তিক বাংলাদেশ গড়া।
তুমি বলেছিলে— ‘মৃত্যুর ফয়সালা জমিনে নয়, আসমানে হয়।’
আর আসমানই তোমাকে ডেকে নিল।
তুমি আগেই বলে গিয়েছিলে— ‘কোনো এক বুলেট হয়তো আমার বুক বিদ্ধ করবে, আর আমি হাসতে হাসতে শহীদ হয়ে যাব।’
কী ভয়ংকরভাবে সত্য হয়ে গেল সে কথা!
আজ দেশজুড়ে ধ্বনি ওঠে— আমরা সবাই হাদি হবো।
কারণ হাদি মানে আপসহীন সাহস, হাদি মানে ভয়হীন সত্য।
সাধারণ কফিনে লাল-সবুজে মোড়া তোমার নিথর দেহ— আজ যেন পুরো বাংলাদেশ।
গুলি শুধু হাদিকে নয়, আঘাত করেছে একটি জাতির মাথায়।
হাদি, তুমি চলে গেছো, কিন্তু তোমার কথাগুলো আগুন হয়ে রয়ে গেছে, তোমার আদর্শ শপথ হয়ে রয়ে গেছে।
হাদীরা জন্মায় না প্রতিদিন। হাদীরা আসে শতকে একবার, হাজার বছরে একবার— ইতিহাসকে জাগিয়ে তুলতে।
বিদায় হাদি, পরপারে শান্তিতে থেকো।
এই বাংলার হৃদয়ে তুমি চিরকাল জীবিত।
স্যালুট শহীদ হাদি।

