• মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ৩১ বৈশাখ ১৪২৯

মহানগর

বর্জ্যের বিষে নীল বুড়িগঙ্গা

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ২৩ জানুয়ারি ২০২২

বুড়িগঙ্গাকে রক্ষায় নেই কোনো সমন্বিত উদ্যোগ। বর্জ্যের বিষে নীল হয়ে গেছে নদীটি। হাজারিবাগ থেকে ট্যানারি সরিয়ে নদীটিকে রক্ষার উদ্যোগ নেওয়া হলেও পরিবর্তন হয়নি বুড়িগঙ্গার পানির রং। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে এখনো বর্জ্য ফেলা হচ্ছে নদীটিতে। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষও (বিআইডব্লিউটিএ) বুড়িগঙ্গা রক্ষায় কিছুই করছে না। সরকারের সমন্বিত উদ্যোগের পাশাপাশি উচ্চ আদালতের নির্দেশ বাস্তবায়ন হলে নদীটিকে রক্ষা করা সম্ভব হবে বলে মনে করছেন পরিবেশবিদরা।

বলা হতো হাজারিবাগ থেকে ট্যানারি সরিয়ে নেওয়া হলে দূষণমুক্ত হবে বুড়িগঙ্গা। আদতে তা হয়নি। এর কারণ অনুসন্ধানে দেখা যায়, শুধু ট্যানারির বর্জ্য থেকে বুড়িগঙ্গা রক্ষা পেলেও অন্যসব বর্জ্য থেকে রক্ষা পাচ্ছে না নদীটি। এক্ষেত্রে নদীটির তীর ঘেঁষে গড়ে উঠা শত শত কলকারাখনা যেমন দায়ী একইভাবে দায়ী ওয়াসা ও ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনও।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকার প্রায় দেড় কোটি মানুষের পয়বর্জ্য সরাসরি পড়ছে বুড়িগঙ্গায়। এসব ড্রেনেজ ব্যবস্থার দায়িত্বে রয়েছে ওয়াসা এবং ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। কিন্তু পয়বর্জ্য পরিশোধন না করে সরসারি নদী ও খালে ফেলা হচ্ছে। যা গিয়ে পড়ছে বুড়িগঙ্গায়।

পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার গৃহস্থালী ও কল-কারখানার সাত হাজার টনেরও বেশি বর্জ্যের ৬৩ ভাগ বিভিন্নভাবে বুড়িগঙ্গায় গিয়ে পড়ে। শুধু হাজারিবাগে অবস্থিত দু-শর বেশি চামড়া কারখানা থেকে প্রতিদিন গড়ে ২২ হাজার ঘন লিটার দূষিত আবর্জনা বের হয়।

আবার হাজারিবাগ থেকে ট্যানারি স্থানান্তরে  কয়েক বছর পূর্বে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বালু ও তুরাগ নদী দখল ও ভরাট পর্যবেক্ষণ এবং দূষণ পরীক্ষা করে। এতে দেখা যায় বুড়িগঙ্গার তলদেশে প্রায় ৭ ফুট পলিথিনের স্তর জমে রয়েছে। পবা জানায়, নদী দূষণেও নদী ভরাট হচ্ছে। নদীর সঙ্গে ৩৬৫টি টেক্সটাইল মিল, ১৯৮টি চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ ট্যানারি, ১৪৯টি ওষুধ প্রস্তুতকারক কারখানা, ১২৯টি ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ, ১১৮টি রাসায়নিক ও কীটনাশক দ্রব্য প্রস্তুতকারক কারখানা, ৬৩টি রাবার ও প্লাস্টিক কারখানা, ৫টি সিমেন্ট কারখানাসহ বিভিন্ন কারখানা ও ওয়ার্কশপ রয়েছে। এসব কারখানা ও ওয়ার্কশপের বর্জ্যে যেমন দূষণ হচ্ছে পানি তেমনি ভরাটও হচ্ছে নদী।

প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, হাজারিবাগ থেকে ট্যানারি স্থানান্তরের পরও কেন এখনো দূষণে বিষাক্ত বুড়িগঙ্গা? এর কারণ ব্যাখ্যায় সংশ্লিষ্টরা বরছেন, শুধু ট্যানারির বর্জ্যেই বুড়িগঙ্গার পানি দূষণের একমাত্র কারণ ছিল না। এই নদীতে গৃহস্থালি পয়বর্জ্যের পাশাপাশি বেসরকারি অনেক শিল্পবর্জ্যও প্রতিদিন পড়ছে। এছাড়া সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও সরাসরি বর্জ্য ফেলছে বুড়িগঙ্গায়।

জানা যায়, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে পরিবেশগত ছাড়পত্রবিহীন যেসব কারখানা ও স্থাপনা বুড়িগঙ্গার পাড়ে রয়েছে সেগুলো বন্ধ করে দেওয়ার জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরকে নির্দেশ দিয়েছিল হাইকোর্ট। এই নির্দেশ বাস্তবায়ন করে পরিবেশ অধিদপ্তরকে ২০২০ সালের ৮ জানুয়ারি এ ব্যাপারে হাইকোর্টে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দেওয়ার নির্দেশ দেয়। একই দিনে বুড়িগঙ্গার সাথে যুক্ত ড্রেন ও সুয়ারেজ লাইনগুলো পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়ার জন্য আদেশ দেওয়া হয়েছিল ঢাকা ওয়াসাকে।

ওই সময় পরিবেশ অধিদপ্তর হাইকোর্টকে এ বিষয়ে প্রতিবেদন দিয়েছিল। প্রতিবেদনে বলা আছে, নদীর দক্ষিণপাড়ে অবৈধভাবে পরিচালিত ৫২টি কারখানা নদীর পানিতে বর্জ্য ফেলে দূষণ ঘটাচ্ছে। ওই কারখানাগুলোর পরিবেশগত ছাড়পত্র ও তরল বর্জ্য শোধনাগার বা ইটিপি প্ল্যান্ট নেই। নদীর উত্তরপাড়েও কিছু কারখানা অবৈধভাবে চলছে। ২০১৭ সালে এ রকম ২৭টি কারখানা এবং এ বছর ১৮টি কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে।

এভাবে কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হলেও এখনো কিছু কারখানা সেখানে বর্জ্য ফেলছে। এরকম চলতে থাকলে কীভাবে বুড়িগঙ্গাকে বাঁচানো সম্ভব জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক এ কে এম রফিক আহমেদ বলেন, দূষণ বন্ধে আইনগতভাবে কাজ করতে গিয়ে অনেক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে আটকে যাই। তারা রিট করে। এগুলো দীর্ঘদিন ধরে চলছে। ছোট করে বলতে পারি, ওয়াসার বর্জ্য সরাসরি বুড়িগঙ্গায় যায়। সিটি করপোরেশনকে বার বার বলেছি, বর্জ্যের ট্রিটমেন্ট করতে। তারা বলে, কাজ করছি। প্রকল্প নেওয়ার কথাও বলে। কিন্তু বাস্তবে তা দেখা যায় না। তারা সময় নেন। কাজ হয় না। এ বিষয়ে সন্মিলিতভাবে কাজ করা দরকার এবং নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে অঙ্গীকারবদ্ধ হওয়া উচিত।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বুড়িগঙ্গা নৌপথটি বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) অধীনে। নৌপথ সচল রাখার কাজ ছাড়া বিআইডব্লিউটিএ আর কিছু করে না। মাঝে মধ্যে প্রতিষ্ঠানটিকে বুড়িগঙ্গার পানির মান উন্নয়নে কিছু কাজ করতে দেখা গেছে। তবে সেগুলোর বেশিরভাগই অপরিকল্পিত।

২০২০ সালের ১৮ মার্চ বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে ড্রেনের মুখে দূষিত পানি পরিশোধনে ‘ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট’ বসানো হয়। বিআইডব্লিউটিএ-র তত্ত্বাবধানে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এটি স্থাপন করে। সেটা এক সপ্তাহও টেকেনি। বিআইডব্লিউটিএ কর্মকর্তারা বলছেন, এটি পরীক্ষামূলক উদ্যোগ ছিল। সফল হলে অন্যগুলোর কথা চিন্তা করা যেত। কিন্তু স্থাপনের কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই ওটা ভেঙে যায়।

বিআইডব্লিউটিএর এক কর্মকর্তা বলেন, আমরা দেখেছি ড্রেন দিয়ে এত বেশি পানি আসে যে প্ল্যান্টগুলো টিকতে পারেনি। এগুলো সমীক্ষা ছাড়াই বসানো হয়েছিল। এতে অর্থের অপচয়ই হয়েছে।

প্রকল্প সংশ্লিষ্ট বিআইডব্লিউটিএ-এর নির্বাহী প্রকৌশলী মতিউল ইসলাম জানান, এই প্রকল্পের জন্য আরো জমি ও বিনিয়োগ প্রয়োজন। তা না হলে এটি কার্যকর করা সম্ভব নয়।

এ ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে বুড়িগঙ্গার দূষণ রোধে এর তলদেশ থেকে পলিথিন উঠানো, পাড় থেকে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদসহ নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও কিছুদিন পর আবার তা বন্ধ হয়ে যায়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বুড়িগঙ্গা বাঁচাতে সমন্বিত উদ্যোগ লাগবে। কারো একার পক্ষে বুড়িগঙ্গাকে বাঁচানো সম্ভব নয়। পরিবেশ, নৌপরিবহন, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয় এবং এসব মন্ত্রণালয়গুলোর বিভিন্ন বিভাগের মাধ্যমে আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করে কাজ করতে হবে।

নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, মন্ত্রণালয়টির নেতৃত্বে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ নদীর দখল-দূষণ রোধে একটি টাস্কফোর্স রয়েছে। যেখানে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীরা কমিটিতে রয়েছেন। এই কমিটি নিয়মিত বৈঠকও করে। দাবি করা হচ্ছে এই কমিটি নদ-নদী রক্ষায় নানা পদক্ষেপও নিয়েছে। তবে এতেও বুড়িগঙ্গার পানি পরিষ্কার হচ্ছে না।

কেন বুড়িগঙ্গা রক্ষার কোনো প্রকল্প আলোর মুখ দেখে না জানতে চাইলে এ নদী বাঁচানোর চেষ্টায় নিয়োজিত সংস্থা ওয়াটার কিপারস বাংলাদেশের সমন্বয়কারী শরীফ জামিল বলেন, বুড়িগঙ্গাকে বাঁচানোর নামে বেশ কিছু প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। ওয়াকওয়ে, সীমানা পিলার, গ্রিনেজ, ইকোপার্ক প্রকল্প ইত্যাদি। তবে এগুলো নদীকে বাঁচাতে নয়, উল্টো ধ্বংসের কাজ করছে। নদীকে খালে পরিণত করা হচ্ছে। নদীর সঙ্গে যুক্ত ছোট ছোট খালগুলো ভরাট করা হচ্ছে। যারা এই ধ্বংস রোধ করতে পারতেন তারাই এর জন্য দায়ী।

তিনি আরো বলেন, নদীকে বাঁচাতে আদালত যে আদেশ দিয়েছিলেন সেগুলো ভুলভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে। আদালতের আদেশ অনুযায়ী, নদী বাঁচাতে কাজ করবে নদী কমিশন। কমিশনকে শক্তিশালী করা এবং আইন বাস্তবায়ন কর‍তে হবে। কিন্তু নদী বাঁচাতে কাজ করছে অন্য সংস্থা। আদালতের আদেশ মানলেও বুড়িগঙ্গা বাঁচার কিছুটা সম্ভাবনা থাকে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads