Logo

জাতীয়

রোজার বাজারে ভিন্ন চিত্র

মো. বাবুল আক্তার

মো. বাবুল আক্তার

প্রকাশ: ০২ মার্চ ২০২৫, ০৮:১৪

রোজার বাজারে ভিন্ন চিত্র

সবকিছু আগের মতো হলেও এ বছর বাজারের চিত্র কিছুটা ভিন্ন। খেজুর ও মুদিপণ্যে কিছুটা স্বস্তি থাকলেও চাল, তেল এবং সবজির বাড়তি দামের মধ্যেই শুরু হলো পবিত্র রমজান মাস। যদিও রোজার আগেই রমজান মাসের কেনাকাটা সেরে নিয়েছেন অনেকেই।

তবে দৈনিক আয়ের মানুষের জন্য এ মাসের কেনাকাটা অনেকটা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। প্রতিবছর রোজা শুরুর আগেই বাজারে খেজুর, চিনি, ছোলা, বেসনের মতো পণ্যের দাম বেড়ে যায়। এবার এই পণ্যগুলোর ক্ষেত্রে এরকম বড় ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি। আর এই পণ্যগুলোর দাম বৃদ্ধি না পাওয়ায় স্বস্তি প্রকাশ করেছেন ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ই। 

বিক্রেতারা স্বস্তি প্রকাশ করে বলছেন, দাম নাগালের মধ্যে থাকায় ক্রেতাদের কেনাকাটার চাহিদা আছে। যা বিক্রেতাদের জন্য ভালো। রমজান-সংশ্লিষ্ট এসব নিত্যপণ্যের দাম 

না বাড়লেও এরই মধ্যে শসা, লেবু ও বেগুনসহ সব ধরনের সবজির দাম বেড়েছে। শুক্র ও শনিবার রাজধানীর কয়েকটি কাঁচাবাজার সরেজমিনে ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিবছর রমজান মাসকে কেন্দ্র করে রোজা শুরুর আগেই বাজার উত্তপ্ত থাকে। বাড়তে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য থাকে খেজুর, শসা, লেবু, বেগুন, ছোলা, ডাল, বেসনের মতো পণ্য। সে হিসেবে এবারের চিত্র কিছুটা ভিন্ন। শনিবার (১ মার্চ) বাজারে দেখা যায়, মানভেদে প্রতি কেজি বাংলা খেজুর ১৮০-২০০ টাকা, মেডজুল খেজুর ১২০০-১৬০০ টাকা, আজোয়া খেজুর ৯০০-১৩০০ টাকা, কামরাঙা মরিয়ম খেজুর ৭০০-১৮৫০ টাকা, মরিয়ম খেজুর ৬০০ টাকা, তিউনেশিয়ার খেজুর ৪৫০ টাকা, কাঁচা খেজুর ৬০০ টাকা, মাশারুক ৭০০-৯০০ টাকা, সুগাই জাতের খেজুর ৯৫০ টাকা, দাবাস খেজুর ৪৬০-৫০০ টাকা, জাহিদি ২০০-৩০০ টাকা এবং বরই খেজুর ৪৫০-৫০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

খেজুর বিক্রেতা আবুল বাসার বলেন, খেজুরের দাম এ বছর অনেক কম। যে খেজুর গত বছর এক হাজার টাকা বিক্রি করেছি সেটা এবার ৬০০ থেকে ৭০০ টাকায় বিক্রি করছি। আরেক বিক্রেতা মো. ইয়াসিন বলেন, এবার খেজুরের দাম কমেছে। আর আগে যেরকম রোজা এলেই দাম বেড়ে যেত এবার সেরকম দাম বাড়েনি। আশা করি, দাম আর বাড়বেও না। এ সময় আল-আমিন নামের এক ক্রেতা খেজুরের দাম নিয়ে বলেন, খেজুর তো আসলে অনেক রকমের আছে। একেক খেজুরের একেক দাম। যে যার সাধ্য অনুযায়ী কেনেন। এবারের ব্যাপারটা কিন্তু আলাদা। আলাদা হচ্ছে এভাবে, আগের বছরগুলোতে আমাদের মিনিমাম দামের খেজুর কিনতে হয়েছে ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকার মধ্যে। এবার আমরা ২০০ টাকাতেও কিনতে পারছি। এক্ষেত্রে আমার কাছে মনে হচ্ছে, খেজুরের দাম নাগালের মধ্যেই আছে।

উল্লেখ্য, এনবিআরের পক্ষ থেকে রমজান মাসে খেজুর সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার জন্য আমদানির ওপর বিদ্যমান কাস্টম ডিউটি ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ, অগ্রিম আয়কর ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩ শতাংশ এবং বিদ্যমান ৫ শতাংশ আগাম কর সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করে অর্থাৎ মোট করহার ৬৩ দশমিক ৬০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩৮ দশমিক ৭০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছিল। আর এনবিআরের এ সিদ্ধান্তের ফলেই খুচরা বাজারে কমেছে খেজুরের দাম। এদিকে, রোজাকে কেন্দ্র করে খেজুরের দাম না বাড়লেও বেড়েছে শসা, লেবু, বেগুনের দাম। এগুলোর মধ্যে লেবুর দাম বেড়েছে দ্বিগুণ হারে। এছাড়াও বাজারে আজকে কয়েকটি সবজি বাদে প্রায় সব সবজির দাম রয়েছে বাড়ন্ত পর্যায়ে।

সবজির দাম বেড়ে যাওয়ার কারণ জানিয়ে বিক্রেতা মো. রাজীব বলেন, সবজির দাম যে রোজার কারণে বেড়েছে এমন না। এখন আসলে শীত শেষ হয়েছে, এই সিজনের সবজি শেষের দিকে। তাই সবজির দাম কিছুটা বেড়েছে। আবার নতুন সিজনের সবজি আসছে সেগুলোরও দাম বেশি, যেহেতু সেগুলো নতুন। তাই এই মাঝামাঝি সময়ে সবজির দাম কিছুটা বাড়তি।

বাজারে মান ও আকারভেদে প্রতি কেজি নতুন দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৪০-৫০ টাকায়। এর মধ্যে ছোট আকারের পেঁয়াজ ৪০ টাকা এবং বড় আকারের পেঁয়াজ ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া প্রতি কেজি নতুন সাদা আলু বিক্রি হচ্ছে ২০-২৫ টাকা, নতুন লাল আলু ২০-২৫ টাকায়। নতুন বগুড়ার আলু ৩০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। আর আজকে নতুন দেশি রসুন ১২০ টাকা, চায়না রসুন ২৪০ টাকা, চায়না আদা ২০০-২২০ টাকা, নতুন ভারতীয় আদা ১৪০ দরে বিক্রি হচ্ছে।

এক্ষেত্রে গত এক মাসের সঙ্গে তুলনায় করলে দেখা যায়, মানভেদে প্রতি কেজিতে নতুন দেশি সাদা আলুর দাম কমেছে ৫ টাকা, নতুন দেশি লাল আলুর দাম কমেছে ৫ টাকা করে। আর প্রতি কেজিতে নতুন বগুড়ার আলুর দাম কমেছে ৫ টাকা। আর পেঁয়াজের দাম কমেছে কেজিতে ৫ থেকে ১০ টাকা। এছাড়া প্রতি কেজিতে চায়না রসুনের দাম বেড়েছে ১০-২০ টাকা। এছাড়া অন্যান্য পণ্যের দাম রয়েছে অপরিবর্তিত। আলু-পেঁয়াজ বিক্রেতারা জানান, রোজায় আলু-পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধি না পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

গত এক মাসের ব্যবধানে এখনো স্বস্তি ফেরেনি মাংসের বাজারে। বরং বেড়েছে গরু ও খাসির মাংসসহ মুরগির দাম। বাজারে প্রতি কেজি গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৮০০ টাকা এবং খাসির মাংস ১২০০ টাকা কেজি দরে। এছাড়া ওজন অনুযায়ী, ব্রয়লার মুরগি ১৯৭-২১০ টাকা, কক মুরগি ২৭০-২৯৫ টাকা, লেয়ার মুরগি ৩০০ টাকা, দেশি মুরগি ৬০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। ফার্মের মুরগির প্রতি ডজন লাল ডিম ১২০ টাকা, সাদা ডিন ১২০ টাকা। এক্ষেত্রে দেখা যায় এক মাসের ব্যবধানে প্রতি কেজিতে গরুর মাংসের দাম বেড়েছে ২০ টাকা, খাসির মাংসে বেড়েছে ৫০ টাকা, ব্রয়লার মুরগি বেড়েছে ৪-১০ টাকা, লেয়ার মুরগি বেড়েছে ১০-১২ টাকা এবং দেশি মুরগির দাম বেড়েছে ৫০ টাকা। এদিকে কক মুরগির দাম কমেছে ২০-৩৫ টাকা। এছাড়া প্রতি ডজনে সব ধরনের ডিমের দাম কমেছে ১০ টাকা।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া চিকেন হাউজের বিক্রেতা মো. সুলতান বলেন, এখন একটু দাম বাড়তি আছে। গত সপ্তাহে আরও কম ছিল। সব ধরনের মুরগির দামই কেজিতে প্রায় ১০ টাকা করে কম ছিল। তবে এখন যে দাম সেটা মোটামুটি ১০ রোজা পর্যন্ত থাকবে সেটা বলা যায়।

এছাড়া বাজারে আকার ও ওজন অনুযায়ী ইলিশ মাছ ১২০০-২৫০০ টাকা, রুই মাছ ৩৫০-৬০০ টাকা, কাতল মাছ ৩৫০-৫০০ টাকা, কালিবাউশ ৪০০-৬০০ টাকা, চিংড়ি মাছ ৮০০-১৬০০ টাকা, কাঁচকি মাছ ৪০০ টাকা, কৈ মাছ ২০০-১০০০ টাকা, পাবদা মাছ ৪০০-৬০০ টাকা, শিং মাছ ৪০০-১২০০ টাকা, টেংরা মাছ ৬০০-১০০০ টাকা।

অন্যান্য সময় রমজান মাস শুরুর আগেই বেসন, ডাল, ছোলা, চিনির মতো মুদি পণ্যের দাম বাড়তে থাকলেও এবার কিন্তু এখনো তেমন কিছু ঘটেনি। তবে সয়াবিন ভেলের সংকটে প্রতিনিয়ত ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। বরাবরের মতো ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়পক্ষেরই অভিযোগ তারা তেল পাচ্ছেন না। বিক্রেতারা বলছেন, তারা বিক্রির জন্য পর্যাপ্ত তেল পাচ্ছেন না। আর ক্রেতারা বলছেন, আবার শুধু তেল তারা কিনতে পারছেন না, সঙ্গে নিতে হচ্ছে অন্যান্য পণ্য।

বাজারে প্রতি কেজি বুটের বেসন ১৪০ টাকা, অ্যাংকর বেসন ৮০-৯০ টাকা, ছোট মসুরের ডাল ১৩৫ টাকা, মোটা মসুরের ডাল ১১০ টাকা, ছোট মুগ ডাল ১৭০ টাকা, খেসারি ডাল ১১০ টাকা, বুটের ডাল ১২০ টাকা, প্যাকেট পোলাওয়ের চাল ১৫০ টাকা, খোলা পোলাওয়ের চাল মান ভেদে ১১০-১৩০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। আর প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৭৫ টাকা, খোলা সয়াবিন তেল ১৫৭ টাকা, প্যাকেটজাত চিনি ১২৫ টাকা, খোলা চিনি ১২০ টাকা, দুই কেজি প্যাকেট ময়দা ১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এক মাসের ব্যবধানে প্রতি কেজিতে বুটের ডালের দাম কমেছে ১৫ টাকা, ডাবলির দাম কমেছে ১০ টাকা, খোলা পোলাওয়ের চালের (মান ভেদে) দাম কমেছে ১০ টাকা, খোলা চিনির দাম কমেছে ৫ টাকা। এছাড়া অন্য কোনো পণ্যের দাম বাড়েনি, রয়েছে আগের দামেই।

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মাহবুবুর রহমান। গতকাল বুধবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ও এর দপ্তর-সংস্থার প্রধানদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে তিনি এ আহ্বান জানান।

সচিব বলেন, রমজান মাসে ভোক্তাদের স্বস্তিতে রাখতে যে কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে তা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ এখন আমাদের অগ্রাধিকার দিতে হবে।

একই সঙ্গে টিসিবির পণ্য বিক্রয় কার্যক্রম মনিটরিং জোরদার করতে কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেন তিনি। এ সময় বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের চেয়ারপারসন এ এইচ এম আহসান, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আলীম আখতার খান, ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মইনুল খান, ব্যণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (রপ্তানি) আব্দুর রহিম খান, অতিরিক্ত সচিব (মহাপরিচালক, বাণিজ্য সংগঠন) মোহাম্মদ নাভিদ শফিউল্লাহ, অতিরিক্ত সচিব (ডব্লিউটিও) ড. নাজনীন কাওসার চৌধুরী, অতিরিক্ত সচিব (এফটিএ) আয়েশা আক্তার এবং ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ ফয়সল আজাদ উপস্থিত ছিলেন।

পিকে/এটিআর

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর