
‘জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন’ বা ‘স্থানীয় সরকার নির্বাচনের আগে জাতীয় নির্বাচন’—এই দুই বাক্যে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভক্তি অনেকটা স্পষ্ট। একসময়ের মিত্র দেশের দুই বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি ও জামায়াত ইসলামী জাতীয় নির্বাচন এবং স্থানীয় নির্বাচন নিয়ে দুই মেরুতে অবস্থা করছে। অন্যদিকে বড় দুই রাজনৈতিক দলের বাইরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের নিয়ে গঠিত নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি গণপরিষদ নির্বাচনের দাবি তোলছে।
- নির্বাচনী ব্যয়ের বরাদ্দ চেয়েছে ইসি
- অক্টোবরে জাতীয় নির্বাচনের তফসিল
- সরকারপ্রধানের জাতীয় নির্বাচন ভাবনায় ইসি
গত দুই মাসে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন কমিশনের সাথে বিভিন্ন দাবি ও প্রস্তাবনা নিয়ে বৈঠক করেছে। এসব বৈঠকে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের বিষয়ে প্রস্তাবনা তুলে ধরেছে। বিএনপির প্রস্তাবনায় ছিল জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন না করার। অন্যদিকে স্থানীয় সরকারে জনপ্রতিনিধি শূন্য হয়ে পড়ায় জনগণের সেবার ভোগান্তি কমাতে আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের প্রস্তবনা দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী।
কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস আগামী ডিসেম্বর মাসে জাতীয় নির্বাচনের সম্ভাব্য তারিখ ঘোষণা করায় জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন সময়ের কারণে অনেকটা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। নির্বাচন কমিশনও সরকারপ্রধানের ঘোষিত সময় অনুযায়ী জাতীয় নির্বাচনকে অগ্রাধিকার দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।
এদিকে জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচন কমিশন ইতোমধ্যে ভোটার তালিকা হালনাগাদ শেষে প্রাথমিক ভোটার তালিকা প্রকাশ করেছে। নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ভোটার সংখ্যা মোট ১২ কোটি ৩৭ লাখ ৩২ হাজার ২৭৪ জন। ভোটারের মধ্যে পুরুষ ৬ কোটি ৩৩ লাখ ৬১ হাজার ৬১৫ জন। নারী ভোটার ৬ কোটি ৩ লাখ ৬৯ হাজার ৬৬৫ জন, হিজড়া রয়েছেন ৯৯৪ জন।
যদি ডিসেম্বর মাসে জাতীয় নির্বাচন করতে হয় তাহলে স্থানীয় নির্বাচন করতে হবে জুন মাসে। যা এক প্রকার প্রায় অসম্ভব। কারণ, স্থানীয় সরকার নির্বাচন সহজ কোনো বিষয় না।
অধ্যাপক ড. আফসার উদ্দিন, নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
এবার ভোটার তালিকা হালনাগাদে মোট ১৮ লাখ ৮২ হাজার ১১৪ জন নতুন করে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এরমধ্যে ১২ লাখ ১৭ হাজার ২৮ জন পুরুষ, নারী ৬ লাখ ৬৫ হাজার ২৪ জন এবং হিজড়া ৬২ জন।
মোট ভোটার তালিকা চূড়ান্ত ভাবে প্রকাশিত হবে জুন মাসে। যেখানে বাড়ি বাড়ি গিয়ে যেসব উপাত্ত পাওয়া গেছে সেগুলো আবার যুক্ত হবে, মৃত ভোটাররা বাদ পড়বেন। ফলে চূড়ান্ত ভোটার তালিকা অনুযায়ী হবে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন।
সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি হিসাবে নির্বাচনী ব্যয়ের জন্য নির্বাচন কমিশন সরকারের কাছে প্রাথমিকভাবে ব্যয়ের চাহিদাপত্র পাঠিয়েছে। চাহিদাপত্রে আগামী অর্থ বছরের বাজেটে জাতীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনের জন্য সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। যেখানে ২ হাজার ৭৯৪ কোটি ৫৫ লাখ টাকা চাওয়া হয়েছে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য। এই অর্থ ব্যয় হবে নির্বাচন পরিচালনা ও আইনশৃঙ্খলা খাতে।
জাতীয় নির্বাচন ঘিরে নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণার সম্ভাব্য তারিখও জানিয়েছে। সংসদ নির্বাচন ডিসেম্বরে করতে হলে অক্টোবর মাসে তফসিল ঘোষণা করবে তারা।
স্থানীয় এবং জাতীয় নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর বিভক্তির মধ্যেও নির্বাচন কমিশনের জাতীয় নির্বাচন অগ্রাধিকার দিয়ে নির্বাচনী প্রস্তুতির বিষয়টি ইতিবাচকভাবে দেখছেন নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. আফসার উদ্দিন।
স্থানীয় সরকার নির্বাচনের একটি সংস্কার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনকে কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। সরকার ডিসেম্বর মাসে জাতীয় নির্বাচন করতে চায়।
আব্দুর রহমান রহমানেল মাছউদ, নির্বাচন কমিশনার
বাংলাদেশের খবরকে তিনি বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় ঘোষণা করেছে ডিসেম্বর মাস। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে স্থানীয় সরকার নির্বাচন ও জাতীয় নির্বাচন নিয়ে মতপার্থক্যে রয়েছে। কোনো দল আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চায়, আবার কোনো দল আগে জাতীয় নির্বাচন চায়।
আসলে বাস্তবতা হলো, যদি ডিসেম্বর মাসে জাতীয় নির্বাচন করতে হয় তাহলে স্থানীয় নির্বাচন করতে হবে জুন মাসে। যা এক প্রকার প্রায় অসম্ভব। কারণ, স্থানীয় সরকার নির্বাচন সহজ কোনো বিষয় না। বাংলাদেশে স্থানীয় সরকারের স্তর তিনটি, ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ও জেলা পরিষদ। আবার শহর পর্যায়ে স্থানীয় সরকার স্তর দুইটি, পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশন। এত নির্বাচন চার থেকে পাঁচ মাসে কখনোই সম্ভব নয়। তাছাড়া গত সরকার নির্বাচন ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে দিয়ে গেছে। নির্বাচন ব্যবস্থা পুনর্গঠন করতেও সময় প্রয়োজন।
স্থানীয় সরকার ও জাতীয় নির্বাচনের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমান রহমানেল মাছউদ বাংলাদেশের খবরকে বলেন, স্থানীয় সরকার ও জাতীয় নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতবিরোধ আছে। গণতান্ত্রিক দেশে এই মতবিরোধ গণতন্ত্রের জন্য ভালো। স্থানীয় সরকার নির্বাচনের একটি সংস্কার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনকে কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। সরকার ডিসেম্বর মাসে জাতীয় নির্বাচন করতে চায়। আমরা জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছি। জাতীয় নির্বাচনের আগে আমাদের হাতে যে সময় রয়েছে, এ সময়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আসলে অসম্ভব।
জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করতে হলে জাতীয় নির্বাচন পিছিয়ে দিতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর মতবিরোধের বিষয়ে তিনি বলেন, আমি মনে করি রাজনৈতিক দলগুলো জাতিগত স্বার্থে ঐক্যমতে আসবে। আমরা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ একটি নির্বাচন জাতিকে উপহার দিতে পারব।
এসআইবি/এটিআর