Logo

জাতীয়

ট্রাম্পের শুল্ক মোকাবিলায়

সুযোগ খুঁজছে বাংলাদেশ

মো. বাবুল আক্তার

মো. বাবুল আক্তার

প্রকাশ: ০৬ এপ্রিল ২০২৫, ০৯:২৬

সুযোগ খুঁজছে বাংলাদেশ

ট্রাম্প প্রশাসন যে কয়েকটি দেশের ওপর সর্বোচ্চ হারে শুল্ক আরোপ করেছে, তার মধ্যে বাংলাদেশ একটি। এই পদক্ষেপ বস্ত্র রপ্তানির ওপর নির্ভরশীল এ দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের ঝাঁকুনি দিতে পারে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের এই বাড়তি শুল্ক আরোপের ঘোষণায়, চরম উদ্বেগ দেখা দিয়েছে দেশটির বাজারে পণ্য রপ্তানিকারী বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের মধ্যে। দায়িত্বশীল সূত্রগুলো জানিয়েছে, গতকাল শনিবার এ বিষয়ে প্রাক-প্রস্তুতিমূলক বৈঠক করেন সংশ্লিষ্টরা। তবে সরকারের এ তৎপরতা বাস্তবে দৃশ্যমান হবে আজ রোববার।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের বাড়তি শুল্কের বিষয়ে বাংলাদেশের অবস্থান জানাতে আজ বেলা ১১টায় ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠকে বসতে যাচ্ছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন, বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমানসহ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। এজন্য মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে বিশেষ আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। বৈঠকে আরোপিত শুল্ক প্রত্যাহার এবং দ্বিপক্ষীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র নিশ্চিত করেছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্তের ফলে বাংলাদেশের ৪০ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি শিল্পে বড় ধরনের আঘাত আসতে পারে। এই ধাক্কা সামলাতে ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনায় বসতে চাইছে বাংলাদেশ। বিশেষ করে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর পথ খোঁজা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যে ধার্য হওয়া শুল্ক কমাতে দেশটির সঙ্গে বাণিজ্য উদ্বৃত্ত কমানোর উপায় খুঁজছে বাংলাদেশ।

যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের মোট রপ্তানির প্রায় ৯০ শতাংশই তৈরি পোশাক। একক দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় পোশাক ক্রেতা। ফলে এই শিল্পের ওপর আঘাত লাগলে অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব পড়বে। গত বছর ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর রাজনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে দেশ।

যুক্তরাষ্ট্র আরোপিত নতুন শুল্ক পণ্যভিত্তিক মানদণ্ডের পরিবর্তে দেশটির সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ঘাটতির ওপর ভিত্তি করে নির্ধারণ করা হয়েছে। কিছু বিশ্লেষক মনে করেন, এই পদ্ধতি বাংলাদেশের মতো বাণিজ্য উদ্বৃত্ত থাকা অনেক ছোট অর্থনীতির দেশের জন্য অন্যায্য।

এদিকে শুল্কের প্রভাব মূল্যায়ন করতে বাংলাদেশ সরকার রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোসহ মূল অংশীদারদের সঙ্গে আলোচনা করেছে। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর উপায়গুলোর মধ্যে অন্যতম হলো যুক্তরাষ্ট্র থেকে তুলাসহ অন্যান্য পণ্য আমদানি বাড়ানো।

বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি বিজিএমইএর প্রশাসক আনোয়ার হোসেন বলেন, আমরা যুক্তরাষ্ট্র থেকে তুলা আমদানি বাড়াতে পারি, তবে আমেরিকান তুলার জন্য একটি নির্ভরযোগ্য সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। ওয়ালমার্ট এবং গ্যাপ ইনকরপোরেটেডের মতো বড় মার্কিন খুচরা বিক্রেতারা প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে বিলিয়ন ডলার মূল্যের পোশাক কেনে। শুল্ক বৃদ্ধি তাদের ক্রয় কৌশল পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য করতে পারে।

অন্যদিকে গত ১৭ মার্চ পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন জানান, কৌশলগত কারণে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার যুক্তরাষ্ট্র থেকে তুলা আমদানির পরিকল্পনা করছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন দেশের ওপর শুল্ক আরোপ করেছে। বাংলাদেশ আগেই শুল্কের আওতায় রপ্তানি করলেও অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের ঝুঁকি সব সময় থাকে। আমরা যদি যুক্তরাষ্ট্র থেকে তুলা আমদানি করি এবং সেই তুলা দিয়ে তৈরি পোশাক রপ্তানি করি, তাহলে তারা আমাদের ওপর উচ্চ শুল্ক আরোপ করতে দ্বিধাগ্রস্ত হবে।

এরপর গত ২৭ মার্চ দেশীয় সুতাশিল্পের সুরক্ষায় স্থলবন্দর দিয়ে সুতা আমদানি বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

যুক্তরাষ্ট্রের অফিস অব ইউএস ট্রেড রিপ্রেজেনটেটিভ তথা বাণিজ্য প্রতিনিধির কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রপ্তানি আগের বছরের তুলনায় ১ দশমিক ১ শতাংশ বেড়ে ৮ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে দেশটির রপ্তানি দেড় শতাংশ কমে ২ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে।

অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, এই শুল্কের কারণে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর জন্য আইএমএফ নির্ধারিত ঋণ কর্মসূচির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিন হয়ে পড়বে। এটি এই দেশগুলোতে তহবিলের ঋণকে ঝুঁকিতে ফেলতে পারে, যা প্রবৃদ্ধির নিম্নমুখী ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দেবে। তবে বাংলাদেশের জন্য কিছুটা ইতিবাচক দিকও রয়েছে। পোশাক খাতে দেশের প্রতিদ্বন্দ্বী শ্রীলঙ্কা (৪৪ শতাংশ) ও ভিয়েতনামের (৪৬ শতাংশ) তুলনায় বাংলাদেশের শুল্কের হার কম (৩৭ শতাংশ)। এটি বাংলাদেশকে একটি তুলনামূলক সুবিধা দিতে পারে এবং কিছু বাজারের হিস্যা দখল করতে সাহায্য করতে পারে।

এদিকে ট্রাম্পের শুল্ক ঘোষণার পর এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ও ভবিষ্যৎ করণীয় নির্ধারণে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে থেকে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা পাওয়ার পর শুক্রবার ছুটির মধ্যেই অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করেছেন অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা, অর্থ ও বাণিজ্যসচিব, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর ভাইস চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

অন্যদিকে, মার্কিন শুল্ক ইস্যুতে তৎপর হয়ে উঠেছে এনবিআরও। ছুটির পর প্রথম কার্যদিবসে এনবিআরের পক্ষ থেকে বাংলাদেশে আমদানি হওয়া যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যতালিকা এবং তার ওপর বাংলাদেশের ধার্য করা শুল্কহার পর্যালোচনা করা হবে। সেই সঙ্গে মার্কিন পণ্যের আমদানি শুল্ক থেকে বাংলাদেশ প্রতিবছর কী পরিমাণ রাজস্ব পায়, তার পরিমাণ বের করারও চেষ্টা করা হবে। পাশাপাশি বাংলাদেশি পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের আলোকিত শুল্কহার প্রত্যাহার বা সহনীয় পর্যায়ের নামিয়ে আনতে মার্কিন কোন কোন পণ্যে শুল্কহার হ্রাস করা যায়, সেগুলো চিহ্নিত করা হবে। এরপর বিষয়টি প্রতিবেদন আকারে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়, অর্থ উপদেষ্টা ও বাণিজ্য উপদেষ্টার কাছে পাঠানো হবে। সে অনুযায়ী সরকার তার নীতিনির্ধারণে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।

এ বিষয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আব্দুর রহমান খান বলেন, বিষয়টি জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট হওয়ায় মার্কিন বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর আরোপিত শুল্কহার কমিয়ে আনতে করণীয় সবকিছুই করবে এনবিআর। এ জন্য আগে বাংলাদেশে মার্কিন পণ্যের ডেটা পর্যালোচনা করা দরকার। আমরা রোববারই তা করার চেষ্টা করব। এতে জাতীয় স্বার্থ বিবেচনায় যদি বাংলাদেশের মার্কিন পণ্যের ট্যারিফ কমাতে হয়, আমরা তা করব।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, পারস্পরিক বাণিজ্য আলোচনার অংশ হিসেবে শুল্ক সমন্বয়ের সুযোগ থাকতে পারে। বাণিজ্য উপদেষ্টা বশির উদ্দিনের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্তকে ঘিরে ‘মেঘ জমেছে’। এটি আর দ্বিপক্ষীয় বিষয় নয়, এটি একটি বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সুনামি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা ঘাটতি কমানোর সুযোগগুলো সক্রিয়ভাবে খতিয়ে দেখছি।

বিকেপি/ওএফ

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর