Logo

জাতীয়

কঠোর শ্রমেও মেলে না দাম

রেজাউল করিম হীরা

রেজাউল করিম হীরা

প্রকাশ: ০১ মে ২০২৫, ১০:১৮

কঠোর শ্রমেও মেলে না দাম

স্বামী-সন্তান নিয়ে ভালোই কাটছিল সুফিয়া বেগমের দিন। হঠাৎ এক দুর্ঘটনা লন্ডভন্ড করে দিল সুফিয়ার সুখের সংসার। দুর্ঘটনায় পা হারানো স্বামী আর দেড় বছরের মেয়ের ক্ষুধা মেটাতে কাজের খোঁজে নামেন সুফিয়া। কিছু দিন বাসা-বাড়িতে কাজ করেন। কিন্তু তাতে তিনজনের ভরণপোষণ মেটানো কঠিন হয়ে পড়ে। বাধ্য হয়ে নির্মাণ শ্রমিকের কাজে যুক্ত হন। মাথার ওপর বালুর ঝাঁকি নিয়ে শুরু হয় সুফিয়ার জীবন-সংগ্রামের নতুন গল্প। 

দৈনিক ৮টা থেকে ৫টা পর্যন্ত চলে হাড়ভাঙা খাটুনি। এত কঠোর শ্রম দিয়েও মেলে না প্রকৃত মজুরি। আছে মজুরিবৈষম্য। পুরুষের চেয়ে কম পারিশ্রমিক পান নারী শ্রমিকরা। দৈনিক গড়ে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা মজুরি পান এই নারী শ্রমিক। এই অল্প টাকায় স্বামী-সন্তান নিয়ে তিন বেলা খাওয়া, বাসা ভাড়া, চিকিৎসা খরচ চালাতে হয়। আবার যেদিন কাজ থাকে না, সেদিন স্বামী-সন্তান নিয়ে এক-দুই বেলা উপোস কাটাতে হয়। 

সুফিয়ার মতো হাজারো নারী শ্রমিক পুরো সংসারের দায়িত্ব মাথায় নিয়ে প্রতিদিন ৮টা-৫টা কাজ করেন। ইমারত নির্মাণ শ্রমিক ইউনিয়ন বাংলাদেশের (ইনসাব) তথ্যমতে, সারা দেশে প্রায় ১ কোটি ৮৬ লাখ নারী শ্রমিক কাজ করেন। এদের মধ্যে ৯২ শতাংশ নারী কাজ করেন অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে। এই খাতগুলোর মধ্যে কৃষি ও নির্মাণ এই দুটি খাত প্রধান। নির্মাণ খাতে মোট নির্মাণ শ্রমিক রয়েছেন ৩৮-৪০ লাখ। তাদের মধ্যে নারী নির্মাণ শ্রমিক আনুমানিক ৩০-৩৫ শতাংশ। অর্থাৎ নির্মাণশিল্পে প্রায় ১০ লাখ নারী শ্রমিক হিসেবে কাজে যুক্ত রয়েছেন। বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ডা. মনীষা চক্রবর্তী বলেন, নির্মাণ খাতে যেসব নারী শ্রমিক কাজ করেন তাদের প্রচুর বৈষম্যের শিকার হতে হয়। দেখা যায়, তাদের কাজ করতে হয় পুরুষের সমপরিমাণ। 

কিন্তু পুরুষের চেয়ে তাদের কম পারিশ্রমিক দেওয়া হয়। পুরুষরা যদি ৫০০ টাকা পান, তাহলে নারীদের দেওয়া হয় ৩০০ টাকা। আবার পুরুষ ৮০০ টাকা পেলে নারীদের দেওয়া হয় ৫০০ টাকা এবং এই নিয়ে কোনো নীতিমালা নেই, কোনো ধরনের আইন নেই। এমনকি সরকারের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে কোনো ধরনের নজরদারি নেই। ১৯০৮ সালেও নারীরা তাদের মজুরির জন্য আন্দোলন করেছিলেন, এখন এই ২০২৪ সালে মজুরির দাবি তোলা হচ্ছে। নারীদের এই মজুরিবৈষম্যের ক্ষেত্রে নির্মাণ খাত বড় একটি উদাহরণ। 

চরম ঝুঁকি নিয়ে উত্তাল সাগর-নদী পাড়ি দিলেও জীবনের কোনো মূল্য নেই নৌযান শ্রমিকদের। তাদের না আছে নিয়োগপত্র-পরিচয়পত্র। কোনো শ্রমিক মারা গেলে নিঃস্ব হয়ে যায় পুরো পরিবার। কারণ প্রভিডেন্ট ফান্ড, ক্ষতিপূরণ কিছুই দেওয়া হয় না তাদের। নেই কল্যাণ তহবিলও। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীতে লাইটার জাহাজের মাস্টার খোরশেদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এসব কথা বলেন। তার পাশের আরেক লাইটার জাহাজের চালক হুমায়ূন রশিদ বলেন, 'অথচ মালিক, শ্রমিক ও সরকারের মধ্যে ২০১৯ সালের শেষে একটি ত্রিপক্ষীয় সভায় এসব সুবিধা দেওয়ার বিষয়ে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয়। পাঁচ বছর পার হলেও কোনো দাবিই আলোর মুখ দেখেনি। 

এমন আতঙ্ক নিয়ে প্রতিদিন সাগর ও নদীপথ পাড়ি দেন দেশের লক্ষাধিক নৌযান শ্রমিক। জীবন ধারণের ন্যূনতম সুবিধা তো মেলেই না, উল্টো ‘পান থেকে চুন খসলেই’ তাদের চাকরি চলে যায়। সামান্য ভুলে যায় প্রাণটাও। 

দেওয়া হয় না ন্যূনতম মজুরি : বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী আশিকুল আলম বলেন, শ্রম মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অসহযোগিতা, মালিকপক্ষের অতি মুনাফার চেষ্টা এবং দায়িত্বপ্রাপ্তদের নির্লিপ্ততায় বছরের পর বছর ধরে ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন নৌশ্রমিকরা। তিনি আরও বলেন, অন্তত পাঁচ বছর আগে থেকে নৌযান শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ২০ হাজার টাকা করার দাবি জানিয়ে আসছেন তারা। সবশেষ বেতন স্কেলে এটি নির্ধারণ করা হয় ৭ হাজার ৮০০ টাকা। সেই বেতনও পান না লস্করসহ নিম্ন পদের ৮০ শতাংশ শ্রমিক। অথচ এসব শ্রমিকের দিনের পর দিন নৌযানে থাকতে হয়। মাসে ৪ হাজার টাকার বেশি ব্যয় হয় শুধু খাবারেই। 

সংশ্লিষ্টরা জানান, পণ্যবাহী একটি লাইটার জাহাজে মাস্টার, চালকসহ অন্তত ১২ জন কর্মী থাকেন। যাত্রীবাহী জাহাজে এ সংখ্যা ১২ থেকে ১৪ জন। এ ছাড়া পণ্য ওঠানো-নামানোসহ বিভিন্ন শ্রমিক এ সেক্টরে আছেন। সব মিলিয়ে দেশে এমন প্রায় দুই হাজার নৌযানে শ্রমিকের সংখ্যা লক্ষাধিক। অথচ নিয়োগপত্র, পরিচয়পত্রের মতো চাকরির অনেক মৌলিক শর্তই পূরণ করেন না মালিকরা। এ নিয়ে বহুবার কর্মবিরতিতে গেছেন নৌযান শ্রমিকরা। প্রতিবারই আশ্বাস পেয়ে কর্মবিরতি প্রত্যাহার করা হয়। তবে শেষ পর্যন্ত অধরাই থেকে গেছে তাদের চাওয়াগুলো। 

লঙ্ঘিত শ্রম আইন : শ্রম আইন অনুযায়ী, নৌযান শ্রমিকদের জন্য পাঁচ বছর পরপর নতুন মজুরি বোর্ড গঠনের কথা। সেখানে বলা আছে, দ্রব্যমূল্য ও পরিবারের লোকজন যেন স্বাচ্ছন্দ্যে চলতে পারে, তা বিবেচনায় নিয়েই বেতন কাঠামো ঠিক করতে হবে। ২০২১ সালের জুনে এই সময়সীমা পার হলেও নতুন মজুরি কাঠামো হয়নি। সবশেষ ২০২২ সালে ১০ দফা দাবিতে নৌযান শ্রমিকরা সারা দেশে ধর্মঘটের ডাক দিলে সরকার দাবি মানার আশ্বাস দেয়। তবে কোনো প্রাপ্যই নিশ্চিত হয়নি। এ ছাড়া শ্রমিক ও মালিকপক্ষের পরস্পরবিরোধী অবস্থানের কারণে দুর্ঘটনা ও কর্মস্থলে মৃত্যুজনিত ক্ষতিপূরণে ১০ লাখ টাকার যৌক্তিক দাবিও রয়ে গেছে অমীমাংসিত। 

বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি শাহ আলম বলেন, নৌপথে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন লক্ষাধিক শ্রমিক। তাদের জীবনমান উন্নয়নে ২০২২ সালের নভেম্বর থেকে নতুন মজুরি কাঠামো কার্যকর হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি। পণ্য পরিবহনে সমতা না থাকায় বিশেষ সুবিধাভোগী কিছু মালিক শুধু গেজেট অনুযায়ী মজুরি দেন। কিন্তু অধিকাংশ নৌ শ্রমিকই গেজেট অনুযায়ী বেতন পান না। নিম্ন পদের কর্মীদের ৯০ শতাংশ নিয়োগপত্রই পান না। কিছু হলেই চাকরিচ্যুত করা হয়। 

শ্রমিকদের এমন অভিযোগ অবশ্য মানতে নারাজ নৌযান মালিকরা। লঞ্চ মালিক সমিতির কেন্দ্রীয় সহসভাপতি সাইদুর রহমান রিন্টু বলেন, ২০১৭ সালে শ্রমিকদের সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল, তারা পরের পাঁচ বছর নতুন কোনো দাবি জানাতে পারবে না। এর পর ২০২২ সালের নভেম্বরে আন্দোলন শুরু করলে বেশ কিছু সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হয়। অথচ পদ্মা সেতু চালুর পর ঢাকা থেকে দক্ষিণে যাতায়াতকারী নৌযান কমেছে প্রায় ৫০ ভাগ। সমানতালে কমেছে আয়। ভাড়া কমিয়ে ব্যয় নির্বাহ করাও তাদের পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন অবস্থায়ও শ্রমিকদের বিভিন্ন দাবি পূরণ করা হয়েছে। সব ঠিক আছে। তবু কেন আন্দোলন?

আরকেএইচ/এমএইচএস


Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর