কওমি মাদ্রাসার শিক্ষকরা কি ‘শ্রমিকের’ উপযুক্ত মর্যাদা পাচ্ছেন?
প্রকাশ: ০১ মে ২০২৫, ১৭:৩২
-68135bb53c16d.jpg)
আজ আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। এ উপলক্ষে সমাজের নানা স্তরের শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতেও দেশের কওমি মাদ্রাসার শিক্ষকদের মর্যাদা নিয়ে কথা বলছে না কেউ। তবে, তারা যে ভালো অবস্থায় নেই, তা উঠে এসেছে কওমি মাদ্রাসায় কর্মরত শিক্ষকদের মতামতে।
রাজধানীর জামিয়া মাদানিয়া বারিধারার (বারিধারা মাদ্রাসা) শিক্ষক মাওলানা মাহমুদ হাসান মাসরুর এ প্রসঙ্গে বলেছেন, আসলে দেশের কওমি মাদ্রাসাগুলোতে কোরআন-সুন্নাহর জ্ঞান যতটুকু আছে এবং যত অভ্যন্তরীণ রীতিনীতি আকাবির ও আসলাফ থেকে চলে আসছে, তার ভিত্তিতেই কওমি মাদ্রাসায় চাকরিরত শিক্ষকদের অধিকার ও দায়িত্ব নিয়ন্ত্রিত হয়। একেবারে যাকে বলে চাকরিবিধি ও শ্রমনীতি- সেটা এখানে অনুসরণ হয় না।
তার মতে- এরপরও গড়পড়তা মাদ্রাসার শিক্ষকরা টাকার অঙ্কে যতটুকু সম্মানী ভাতা (হাদিয়া) পান, বর্তমান উচ্চমূল্যের বাজারে তা ন্যায্য পারিশ্রমিক সাব্যস্ত হতে পারে না। এর জন্য মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের আরও আন্তরিক হওয়া দরকার। কারণ, বর্তমানে তাকওয়া-পরহেজগারীর অভাবের কারণে শরিয়া নির্দেশিত চাকরিবিধি ও শ্রমনীতি লঙ্ঘনের ঘটনাও ঘটে থাকে।
মাওলানা মোহাম্মদ মাসরুর বলেন, এ অবস্থায় বেফাকের মাধ্যমে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষকগণের অধিকার ও দায়িত্ব বিষয়ক নির্দেশিকা তৈরি হলে শিক্ষক হিসেবে একজন শ্রমিকের দায়িত্ব ও অধিকার আরও সহজে আদায় করা এবং বুঝে পাওয়া সহজ হবে।
পাশাপাশি তিনি আরও বলেন, আরেকটা বিষয় হলো, মাদ্রাসার শিক্ষকগণ নিজেদেরকে শ্রমিক ভাবেন না, তাদের মাসিক বেতনটুকুই কেবল তাদের প্রাপ্য এমন নয়, তাদের দিক থেকে বেতনকে তারা বরং একটি জরুরত (প্রয়োজন) হিসেবে গ্রহণ করে থাকেন। অন্যথায় কওমি মাদ্রাসার মহান শিক্ষকগণের সামনে পরকালের সওয়াব, দ্বীনী দায়িত্ব আদায়, ঈমান আমল ও মান-মর্যাদার সুরক্ষা প্রাধান্য পেয়ে থাকে। বরং তারা মনে করেন, এগুলোই তাদের প্রকৃত বেতন ভাতা। এ সত্ত্বেও একজন শিক্ষক সম্মানজনক জীবন যাপন করতে পারেন, টাকার অঙ্কে সেই পরিমাণ ভাতা নির্ধারণ করে দেওয়া শরীয়ত মোতাবেক ওয়াজিব।
রাজধানীর জামিয়া সওতুল হেরার সিনিয়র মুহাদ্দিস মাওলানা তাহমিদ বিন ইকরাম এ প্রসঙ্গে বেশ আক্ষেপের সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি মনে করেন- কওমি মাদ্রাসার শিক্ষকদের অবস্থা উট পাখির মতো। উট পাখির ক্ষেত্রে যেমন পাখি নাকি প্রাণী- এটা নির্ধারণ করা যায় না। মানে যখন সুবিধা ও মূল্যায়নের প্রশ্ন আসে তখন বলা হয়- তারা স্বেচ্ছাসেবী অর্থাৎ খেদমত করছে। আবার যখন দায়িত্ব পালন ও সেবা দেওয়ার প্রশ্ন আসে, তখন পৃথিবীর সবচাইতে কঠিন আইন ও রুটিনের চাকরিজীবীর দায়িত্ব তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। যা খুবই দুঃখজনক বাস্তবতা।
তিনি বলেন, এটার সমাধান অত্যন্ত সহজ হলেও কেন্দ্রীয়ভাবে এর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। তবে, কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান নিজস্ব পরিসরে কিছুটা চিন্তা ও তার বাস্তবায়ন করেছে। আর আমরা যারা চার দেয়ালের বাইরে আছি, আমরা নিজেদের মতো করে একটা জোড়াতালি লাগিয়ে চলছি আরকি। ফলাফল মেধাবী শিক্ষকদের খুবই সামান্য অংশ বর্তমানে আবাসিক শিক্ষকতায় আছেন এবং এক্ষেত্রে ভবিষ্যৎ আরও সংকটপূর্ণ হবে।
মাওলানা তাহমিদ বিন ইকরাম নিজের উদাহরণ দিয়ে আরও বলেন, আমরা যারা খণ্ডকালীন শিক্ষকতায় আছি, আমরা বুঝতে পারছি, আমরা আমাদের নিজেদের মেধা ও যোগ্যতার খুব কম অংশই বিতরণ করতে পারছি। এটার ফলাফল সুদূরপ্রসারী হবে। ভবিষ্যতে মেধাবী শিক্ষকের সংকটের কারণে ছাত্ররা অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত থেকেই পাস করবে। যার পরিণতি খুব ভালো হবে না।
মাওলানা রায়হান আনওয়ারও কওমি মাদ্রাসার একজন মেধাবী শিক্ষক। মাদ্রাসায় শিক্ষকদের অবস্থান নিয়ে তারও বড় আক্ষেপ। তিনি বলেন, কওমি মাদ্রাসার শিক্ষকরা বাংলাদেশের সবচেয়ে অবহেলিত জনগোষ্ঠী। এখানে মেধা ও শ্রমের মূল্য নেই। যার ফলশ্রুতিতে দিন দিন মেধাবী তরুণরা বিকল্প কর্মসংস্থান খুঁজে নিচ্ছেন। এটা এই শিক্ষাব্যবস্থার জন্য এক অশানি সংকেত। দ্রুতই দায়িত্বশীলরা যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে এই শিক্ষাব্যবস্থা ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হবে।
উদাহরণ হিসেবে তিনি বরেন, বলা যায়- পৃথিবীর সকল প্রতিষ্ঠানে সর্বোচ্চ কর্মঘণ্টা হচ্ছে ১০ ঘণ্টা। সেখানে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষকদের কর্মঘণ্টা হচ্ছে ১৪ থেকে ১৬ ঘণ্টা। বেতন ভাতা সময়মতো না পাওয়া স্বাভাবিক অবস্থা হিসেবে গণ্য করা হয়। এমন আরও অসংখ্য সমস্যা অনেক কওমি মাদ্রাসায় রয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে সংকট খুব নিকটে।
এ প্রসঙ্গে আল-হাইআতুল উলয়া লি-জামিআতিল কওমিয়্যাহর সদস্য ও বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের সহসভাপতি মাওলানা মুসলেহ উদ্দিন রাজু বলেন, আসলে কওমি মাদ্রাসায় শিক্ষকতাটা চাকরি না যে, এটাকে শ্রম হিসেবে বিবেচনা করা হবে; বরং এটা খেদমত। এর বিপরীতে যেটা দেওয়া হয়, সেটা হাদিয়া; পারিশ্রমিক নয়। এজন্য কওমি মাদ্রাসায় খেদমতের আগে আমাদের আকাবিরদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে হবে, তাহলে আর এটা নিয়ে প্রশ্ন থাকবে না।
তবে তিনি মনে করেন- কওমি মাদ্রাসার শিক্ষকরা যে পরিমাণ পরিশ্রম করেন এবং তারা মাদ্রাসার প্রতি যতটা আন্তরিক, সেই হিসাবে সামর্থ অনুযায়ী মাদ্রাসাগুলোরও আরও দায়িত্বশীল আচরণ করা দরকার।
ডিআর/বিএইচ