Logo

জাতীয়

নির্বাচনের রোডম্যাপ ও দলগুলোর অবস্থান

দূরত্ব বাড়ছে সব পক্ষের

মো. বাবুল আক্তার

মো. বাবুল আক্তার

প্রকাশ: ৩০ মে ২০২৫, ১০:২৪

দূরত্ব বাড়ছে সব পক্ষের

রাজনীতিতে এক ধরনের চাপা উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে। কিছুদিন ধরে বিভিন্ন ইস্যুতে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনা ঘিরে কর্মসূচি, সেনাপ্রধানের বক্তব্য, বিএনপি ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) পাল্টাপাল্টি অবস্থান এবং ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পদত্যাগ ভাবনা-সব মিলিয়ে দেশের রাজনৈতিক মাঠ ক্রমেই অস্থির হয়ে উঠেছে। সরকার, বিরোধী দল ও সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে মতভিন্নতা দৃশ্যমান, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে। 

বিশেষ করে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণাকে কেন্দ্র করে সরকারের সঙ্গে দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল বিএনপির দূরত্ব প্রতিদিনই বাড়ছে। একই সঙ্গে, সেনাবাহিনীর সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের দূরত্ব নিয়েও জনপরিসরে আলোচনা জোরালো হচ্ছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যেমন ঐক্যের অভাব, তেমনি কাজ করছে নানা কৌশলগত সমীকরণ। এনসিপি, জামায়াতে ইসলামী, বিএনপি প্রতিটি দলই নিজেদের স্বার্থ ও অবস্থান থেকে রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে চাইছে। এসব বিষয় অনেক ক্ষেত্রে সরকার ও অন্যান্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাদের সম্পর্ককে বৈরিতার পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে। 

গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কে হবেন-তা নিয়ে প্রাথমিক পর্যায় থেকেই বিভক্তি তৈরি হয়। অতীতের কিছু ঘটনা, যেমন-আওয়ামী লীগের বিতর্কিত নেতাদের দেশত্যাগ এবং পুলিশ বাহিনীর অকার্যকর ভূমিকা- সন্দেহ ও অনাস্থা আরও বাড়িয়ে তোলে। পরিস্থিতি সামাল দিতে মাঠে নামানো হয় সশস্ত্র বাহিনীকে, কিন্তু সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তাদের ভূমিকা নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন। 

এদিকে ২১ মে ঢাকা সেনানিবাসে সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান কর্মকর্তাদের উদ্দেশে এক বক্তব্যে বলেন, ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন হওয়া উচিত। তার এই বক্তব্য সামাজিক ও গণমাধ্যমে ব্যাপক চর্চা পায় এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন মাত্রা যোগ করে বিএনপি সেনাপ্রধানের বক্তব্যকে সমর্থন জানায়। তাদের মতে, এতে প্রমাণ হয় অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচনের সময় নিয়ে টালবাহানা করছে। 

অন্যদিকে, প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনুস আগেই জানিয়ে রেখেছেন, নির্বাচন ডিসেম্বর ২০২৫ থেকে জুন ২০২৬ সালের মধ্যে হবে ফলে সেনাপ্রধানের বক্তব্যকে অনেকেই ভিন্নমতের প্রকাশ এবং রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টির কৌশল হিসেবে দেখছেন। 

এদিকে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে মেয়র হিসেবে দায়িত্ব দেওয়ার দাবিতে দলটি যমুনা ঘিরেও আন্দোলনে নামে। এর মাধ্যমে তারা সরকারের ওপর এক ধরনের চাপ প্রয়োগ করে। বিএনপি দুই ছাত্র উপদেষ্টা ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করে। পাল্টা হিসেবে এনসিপি তিন উপদেষ্টাকে বিএনপিপন্থি আখ্যা দিয়ে তাদের অপসারণ চায়। এনসিপি নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের দাবিও তোলে।

এই উত্তেজনার মাধ্যে ২২ মে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস তার পদত্যাগের ভাবনার কথা জানান। বিষয়টি ফাঁস হলে নতুন করে অস্থিরতা তৈরি হয়। বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির মধ্যে এ নিয়ে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু হয়। তবে ২৪ মে একনেক বৈঠকের পর উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যরা ঐক্যবদ্ধভাবে দায়িত্ব পালনের অঙ্গীকার করেন। 

অন্যদিকে, বিএনপি সরকারের সঙ্গে আলোচনায় সন্তুষ্ট নয়। তারা দ্রুত নির্বাচনের জন্য সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ দাবি করেছে। তারেক রহমান নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে সরকারকে কঠোর বার্তা দিয়েছেন। আর এনসিপি স্থানীয় সরকার নির্বাচন ও মৌলিক সংস্কারের পক্ষে অবস্থান নিয়ে জাতীয় নির্বাচনের সময় পিছিয়ে দেওয়ার পরোক্ষ সমর্থন দিচ্ছে। 

এনসিপি ও জামায়াতের মধ্যে কিছু নীতিগত মিল থাকলেও রাজনৈতিকভাবে তারা পুরোপুরি একমত নয়। এনসিপির কিছু চিন্তা সরকারের কিছু উপদেষ্টার সঙ্গে মিলে যাওয়ায় বিএনপি এটিকে সন্দেহের চোখে দেখছে। 

বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতা মূলত পারস্পরিক অনাস্থা ও সংঘাতমুখী অবস্থান থেকে জন্ম নিচ্ছে। সরকারের ওপর জনগণের আস্থা নড়বড়ে, বিরোধীদের মধ্যে ঐক্যের অভাব, সেনাবাহিনী মুখে নিরপেক্ষ থাকলেও ভিতরে চিন্তা-ভাবনার পার্থক্য- সব মিলিয়ে রাজনৈতিক পরিস্থিতি অত্যন্ত সংবেদনশীল হয়ে উঠেছে।

প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, তিনি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর। তবে রাজনৈতিক চাপ বা সংকট বাড়লে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে তিনি পিছপা হবেন না। 

এদিকে, বিএনপি জাতীয় নির্বাচনের সময়সূচি নিয়ে এবার কঠোর অবস্থানে গেছে। বুধবার নয়াপল্টনে সমাবেশে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান জানিয়েছেন, ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন দিতে হবে। তার বক্তব্যে আলটিমেটামের সুর স্পষ্ট ছিল।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর চাপ তৈরি করতেই বিএনপির এই বক্তব্য। নির্বাচন নিয়ে চাপ বাড়াতে গিয়ে বিএনপি একা হয়ে পড়ছে কি না, তা নিয়েও রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা চলছে। কারণ, বিএনপির এই অবস্থানে নেই প্রভাবশালী অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তি। 

জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থান থেকে উঠে আসা জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও জামায়াতে ইসলামীর অবস্থান সরকারের নির্বাচনি সময়সূচির পক্ষে। ফলে বিএনপির এই দাবি ঘিরে তারা কোনো সংহতি দেখাচ্ছে না। 

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের দুই বড় অংশীজন হচ্ছে বিএনপি এবং সেনাবাহিনী। এই দুই পক্ষ সহযোগিতা না করলে সরকার চাপের মুখে পড়বে। তাই তারা গণতান্ত্রিক কর্মসূচির মাধ্যমে সরকারকে চাপে ফেলতে চান। সরকার বাধ্য না হলে রোডম্যাপ দেবে না। 

জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের বলেছেন, তারা নির্বাচন চান রমজানের আগ বা পরে। এই অবস্থানকে ভিন্নভাবে দেখা অনুচিত তবে সংস্কার শেষ না করে যদি কোনো নির্বাচন হয়, এই নির্বাচনে জনগণ তাদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবে না। আবার সব সংস্কার এখন করা সম্ভবও না। মাত্র ৫টা সুনির্দিষ্ট বিষয়ে তারা হাত দিয়েছেন। এতটুকু নিষ্পত্তি করা দরকার সন্তোষজনকভাবে। 

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের সরকার। আমরা মনে করি, এই সরকার গণঅভ্যুত্থানের পরে তৈরি হয়েছে তাই গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের দায়বদ্ধতা রয়েছে। গণহত্যার বিচার এবং রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কারের মধ্য দিয়েই সরকারকে নির্বাচনের দিকে যেতে হবে। 

রাজনৈতিক বিশ্লেষক দিলারা চৌধুরী মনে করেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন সবচেয়ে বড় সংকট হলো- আস্থার সংকট। অন্তর্বর্তী সরকার, সেনাবাহিনী এবং প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কার্যকর সম্পর্ক না থাকায় গণঅভ্যুত্থানের ৯ মাস পরেও একটি গ্রহণযোগ্য রোডম্যাপ আসেনি বরং বেড়েছে সন্দেহ, দূরত্ব এবং মুখোমুখি অবস্থান। জনগণ চায় একটি শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক উত্তরণ। এর জন্য এখন জরুরি রাজনৈতিক সংলাপ, আন্তরিকতা এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরপেক্ষ ও দায়িত্বশীল ভূমিকা। তা না হলে পরিস্থিতি যে কোনো সময় অনভিপ্রেত ও নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।

বিকেপি/এমএইচএস

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর