Logo

জাতীয়

রাজনৈতিক সংকটের শঙ্কা

নির্বাচন এপ্রিলে, বিএনপি অনড় ডিসেম্বরে

এম এ বাবর

এম এ বাবর

প্রকাশ: ১১ জুন ২০২৫, ০৯:১২

রাজনৈতিক সংকটের শঙ্কা

বাংলাদেশে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন (২০২৬ সালের প্রথমার্ধে) ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গনে তীব্র টানাপড়েন চলছে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচন দ্রুত আয়োজনের দাবি জানিয়ে আসছে, বিশেষত ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যেই। 

অপরদিকে, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ঘোষণা দিয়েছেন, নির্বাচন ২০২৬ সালের এপ্রিল মাসের প্রথমার্ধে হবে। প্রধান উপদেষ্টা এমন ঘোষণা দেওয়ার পর দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ফের উত্তাপ ছড়িয়েছে। তার এ ঘোষণার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বিএনপি। দলটি তাদের পুরোনো অবস্থানে অনড় থেকে জানিয়ে দিয়েছে, নির্বাচন এ বছর ডিসেম্বরের মধ্যেই সম্পন্ন করতে হবে।

প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের পরপর রাতেই বৈঠকে বসে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটি। লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে সভাপতিত্ব করেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। ওই সভায় সিদ্ধান্ত হয়, ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি থেকে বিএনপি এক চুলও নড়বে না। এর মধ্যে আগামী শুক্রবার লন্ডন সময় বেলা ১১টায় তারেক রহমানের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার সাক্ষাৎ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। 

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বৈঠকের ফলাফলের ওপর নির্ভর করবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক গতিধারা। যদি সমঝোতা হয়, তাহলে নির্বাচনি রোডম্যাপ স্পষ্ট হবে। সংস্কার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হতে পারে। আর আলোচনা ব্যর্থ হলে বাড়তে পারে রাজনৈতিক অস্থিরতা। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতি এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। একদিকে নির্বাচন ও সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর বিরোধী অবস্থান, অন্যদিকে একটি আস্থাশীল ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য জনগণের আকুতি। 

এ পরিস্থিতিতে লন্ডনে ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও তারেক রহমানের বৈঠকটি নিছক একটি সৌজন্য সাক্ষাৎ নয়, বরং এটি রাজনৈতিক বরফ গলানোর একটি বড় সুযোগ। এই আলোচনা যদি বিশ্বাসযোগ্য ও বাস্তবসম্মত সমাধানমুখী হয়, তবে তা কেবল বিএনপি বা সরকারের জন্য নয়, বরং দেশের গণতন্ত্র ও রাজনীতির ভবিষ্যতের জন্যই একটি ইতিবাচক দিকচিহ্ন হয়ে উঠবে। 

এদিকে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার দূরদর্শী হস্তক্ষেপে দলের কঠোর অবস্থান নমনীয় হয়েছে বলে জানা গেছে। লন্ডনে অনুষ্ঠেয় বৈঠককে ঘিরে যেমন তৈরি হয়েছে বিপুল প্রত্যাশা, তেমনি এর ফলাফলের ওপর নির্ভর করছে দেশের আগামী দিনের রাজনীতির গতিপ্রকৃতি। 

একদিকে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবিতে সোচ্চার বিএনপি ও তার মিত্ররা, অন্যদিকে সরকারের এপ্রিলে নির্বাচন আয়োজনের ঘোষণা- এই বিপরীতমুখী অবস্থানের মধ্যে ইউনূস-তারেক বৈঠক কি পারবে রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসন করে একটি সমঝোতার পথ তৈরি করতে! 

গত ৬ জুন জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস যখন আগামী বছরের (২০২৬) এপ্রিলের প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচনের ঘোষণা দেন, তখন তীব্র ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানায় বিএনপি। দলটির পক্ষ থেকে রমজান মাস এবং বৈরী আবহাওয়ার কারণ দেখিয়ে এই সময়সূচিকে ‘বাস্তবসম্মত নয়’ ও ‘নির্বাচন বিলম্বিত করার কৌশল’ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়। 

রাজনৈতিক অঙ্গনে যখন সরকার ও বিএনপির মধ্যে সরাসরি সংঘাতের আশঙ্কা বাড়ছিল, ঠিক তখনই দৃশ্যপটে আসেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদ জিয়া। ঈদের দিন, ৭ জুন রাতে, দলের সিনিয়র নেতারা যখন তাকে শুভেচ্ছা জানাতে গুলশানের বাসভবন ‘ফিরোজা’য় যান, তখন তিনি চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা দেন। একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্রমতে, বেগম জিয়া নেতাদের বলেন, প্রকাশ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে সংঘাতে গেলে বিএনপির কোনো লাভ নেই, বরং দাবি থাকলে তা আলোচনার টেবিলে বসে সমাধান করতে হবে। সরকারের বিরুদ্ধে সংঘাতপূর্ণ ও আক্রমণাত্মক কথাবার্তায় তিনি অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। 

চেয়ারপারসনের এই পরামর্শই বিএনপির রাজনৈতিক কৌশল পরিবর্তনের প্রধান অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। এর পরপরই সোমবার (৯ জুন) রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটি এক জরুরি বৈঠকে বসে এবং সর্বসম্মতিক্রমে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সঙ্গে তারেক রহমানের বৈঠকের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। দলকে সংঘাতের পথ থেকে সরিয়ে আলোচনার পথে নিয়ে আসার এই কৃতিত্ব বেগম খালেদা জিয়ার বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। 

অন্যদিকে আগামী শুক্রবার লন্ডনের অভিজাত ডরচেস্টার হোটেলে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মধ্যে একটি ‘ওয়ান-টু-ওয়ান’ বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকেই এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়েছে যে, স্থানীয় সময় সকাল ৯টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত বৈঠকের জন্য দুই দুই ঘণ্টার সময় বরাদ্দ রাখা হয়েছে। আর উভয় পক্ষই এই বৈঠক নিয়ে বেশ আশাবাদী।

এদিকে গতকাল মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এই বৈঠককে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে একটি টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি জানান, স্থায়ী কমিটির বৈঠকে তারেক রহমানকে এ বিষয়ে যে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার পূর্ণ এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে। এই সাক্ষাতে অনেক সমস্যার সমাধান সহজ হয়ে যাবে বলে আমরা মনে করছি। রাজনৈতিক অচলাবস্থা দূর করার একটি বাস্তব সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। জাতীয় স্বার্থে এই দুই নেতার মধ্যে সংলাপ একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ হিসেবে এসেছে।

সরকারের পক্ষ থেকেও এই বৈঠককে ইতিবাচক হিসেবে দেখা হচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিফুল আলম গণমাধ্যমকে বলেন, তারেক রহমান বাংলাদেশের বড় একটি রাজনৈতিক দলের নেতা, তার সঙ্গে লন্ডন সফরে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক দেশের জন্য পজিটিভ মেসেজ। এই বৈঠকের মাধ্যমে বিএনপির মতো একটি বৃহৎ দলের সঙ্গে সরকারের সম্পর্কের যে টানাপড়েন ও অস্বস্তি চলছে, তা অনেকাংশে কেটে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। 

দেশে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার মূল কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়সূচি। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান ১৮ মাসের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের কথা বলার পর থেকেই সরকারের ওপর একটি রোডম্যাপ ঘোষণার চাপ বাড়ছিল। সেই প্রেক্ষাপটে ড. ইউনূস এপ্রিলে নির্বাচনের ঘোষণা দিলে তা নতুন বিতর্কের জন্ম দেয়। বিএনপি ও তার সমমনা ১২ দলীয় জোটসহ ৩০টির বেশি রাজনৈতিক দল ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানিয়ে আসছিল। তাদের মতে, রমজান মাস, কালবৈশাখি, খরা এবং এসএসসি এইচএসসি পরীক্ষার কারণে একটি উৎসবমুখর ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পরিবেশ থাকবে না। ১২ দলীয় জোট সরকারের এই আশ্বাসকে ‘এপ্রিল ফুল’ হওয়ার শঙ্কা হিসেবেও অভিহিত করেছে। 

অন্যদিকে, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) সরকারের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে, তবে শর্তসাপেক্ষে। এনসিপির নেতা সারজিস আলম বলেছেন, দৃশ্যমান বিচারিক কার্যক্রম এবং নির্বাচনকালীন সংস্কার নিশ্চিত করা হলে এপ্রিলে নির্বাচনে তাদের আপত্তি নেই। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, আমরা প্রধান উপদেষ্টার কথায় আস্থা রাখতে চাই। তিনি ইতোমধ্যে বলেছেন এপ্রিলে নির্বাচন দেবেন। তিনি যেন জাতিকে দেওয়া তার কথা রক্ষা করেন। তবে এই নির্বাচন যাতে সুষ্ঠু হয়, জনগণ যাতে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে। সব ধর্মের মানুষ নিয়ে মিলেমিশে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আমরা নতুন বাংলাদেশ গড়তে ভাই, যেখানে ধর্মের ভিত্তিতে বিভেদের কোনো দেয়াল থাকবে না। 

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশের সিংহভাগ রাজনৈতিক দলের মতামত উপেক্ষা করে জামায়াতের পরামর্শ গ্রহণ করায় সরকারের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সাইফুল আলম চৌধুরীর মতে, ওরা চাইলো কেন, তাই দেবো না- মনে হয় এই ইগো থেকেই সংখ্যাগরিষ্ঠ দলগুলোর মতকে উপেক্ষা করা হয়েছে। এছাড়া ভাষণে বন্দর ও করিডরের মতো নীতিনির্ধারণী বিষয়ে কথা বলায় প্রধান উপদেষ্টা তার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ম্যান্ডেট অতিক্রম করেছেন বলেও অভিযোগ তুলেছে বিএনপি। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোহাম্মদ মজিবুর রহমান মনে করেন, সবার মতের ভিত্তিতে নির্বাচন নিয়ে সিদ্ধান্ত হলে এ বিতর্ক হতো না এবং ভাষণে কিছু বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা যে ভাষা প্রয়োগ করেছেন সেটি সঠিক ছিল না। নির্বাচন এপ্রিলের মতো প্রতিকূল সময়ে কেন করতে হবে সে বিষয়ে কোনো ব্যাখ্যা তিনি দেননি। জানুয়ারির মধ্যে না হলে সেটি পরবর্তী ডিসেম্বর পর্যন্ত বিলম্বিত হতে পারে এমন ভয়ও আছে অনেকের। আর সেটি হলে নির্বাচন আদৌ হায় কি-না সেই শঙ্কাও দেখা দিতে পারে। 

তার মতে, ‘সব মিলিয়ে আবারো একটি অনিশ্চয়তা, আশঙ্কা ও অচলাবস্থার দিকেই দেশ যাচ্ছে কি-না সেই প্রশ্নও উঠবে এখন।’ 

এদিকে, বিএনপির দাবি কেবল নির্বাচনের তারিখ পরিবর্তনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী জানান, তারা নির্বাচনের আগে একটি ‘কেয়ারটেকার আদলের সরকার’ দেখতে চান, যেখানে বিতর্কিত উপদেষ্টাদের কোনো জায়গা থাকবে না। তার মতে, এই সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে যদি প্রশ্ন উঠেই যায়, তাহলে তো আমাদের পুরো প্রক্রিয়াটায় এগোনোর কোনো সুযোগ নেই, এটা বিফলে যাবে।

এমএবি/এমএইচএস

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচন

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর