
সফর শেষ করে শনিবার ঢাকায় ফিরেছেন অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। ছবি : সংগৃহীত
ব্রিটেনে চেষ্টা করেও সেদেশের সরকার প্রধানের সাক্ষাৎ না পাওয়া এবং বাংলাদেশেরই একটি রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতার সঙ্গে ‘দ্বিপাক্ষিক বৈঠক ও যৌথ বিবৃতির’ নজিরবিহীন ঘটনার মধ্য দিয়ে যুক্তরাজ্য সফর শেষ করে দেশে ফিরে এসেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
এই সফরে অধ্যাপক ইউনূস ও তার সফরসঙ্গীদের সবাইকে লন্ডনের বিলাসবহুল একটি হোটেলে রাখতে গিয়ে রাষ্ট্রের বিপুল অর্থ ব্যয়ের প্রসঙ্গটি নিয়েও ব্যাপক আলোচনা- সমালোচনা হচ্ছে সামাজিক মাধ্যমে।
প্রশ্ন উঠছে, যুক্তরাজ্য সফরে গিয়ে কি অর্জন হলো? সফর শেষ করে অধ্যাপক ইউনূস ও তার সফরসঙ্গীরা শনিবার ঢাকায় ফিরেছেন।
কূটনীতির ক্ষেত্রে একজন সরকার প্রধানের সরকারি ও দ্বিপাক্ষিক সফরে অন্য দেশে যাওয়ার সফর ঠিক হয় সাধারণত সেই দেশের সরকার প্রধানের সাথে সাক্ষাৎ ও আলোচনার বিষয়বস্তু কর্মকর্তা পর্যায়ে চূড়ান্ত হবার পর।
কিন্তু অধ্যাপক ইউনূস যুক্তরাজ্য সফরে গিয়ে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ের স্টারমারের সাক্ষাৎ পাননি। একই সাথে তিনি যুক্তরাজ্যে সদলবলে পৌঁছানোর পর তার প্রেস উইং থেকে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাতের চেষ্টা হচ্ছে বলার পর এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে সামাজিক মাধ্যমে।
সরকার প্রধানের দ্বিপাক্ষিক সফর হলেও এতে সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা, সচিবসহ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তৎপরতা দেখা না যাওয়া নিয়েও নানা ধরনের আলোচনা হচ্ছে । ড. ইউনূসকে লন্ডন বিমানবন্দরে স্বাগত জানিয়েছেন বাংলাদেশের হাইকমিশনার।
সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলছেন, প্রধান উপদেষ্টা একটি দেশে সরকারি সফরে গিয়ে সেখানকার সরকার প্রধানের সাক্ষাৎ না পাওয়া এই সফরের নেতিবাচক একটি উপাদান।
‘কিংস হারমনি অ্যাওয়ার্ড সফরের ইতিবাচক দিক। আর সরকারি সফরে গিয়ে দেশের রাজনৈতিক আলোচনাটি নতুন ও আকর্ষণীয় পর্যায়ে যাওয়া আরেকটি দিক। তবে সফরটি কূটনৈতিক। সে জায়গা থেকে কী অর্জন করল বাংলাদেশ সেই প্রশ্ন থাকবে,’ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমদ বলছেন, তার মতে, পুরো সফরটিই নানা ব্যর্থতায় প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
‘শুধু এটি নয়, গত বছর অগাস্টে ক্ষমতা নেয়ার পর থেকে তিনি এ পর্যন্ত যে কয়টি সফরে গেছেন সত্যিকার অর্থে এগুলো কতটা দ্বিপাক্ষিক সফর ছিল, সেটি নিয়েও প্রশ্ন আছে,’ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন মুন্সী ফয়েজ আহমদ।
সরকারি সফর কিন্তু বাংলাদেশের অর্জন কী
চার দিনের এই সফরে প্রধান উপদেষ্টার সাথে যুক্তরাজ্যের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা, হাউজ অব কমন্সের স্পিকার, যুক্তরাজ্যের বাণিজ্যমন্ত্রী, অল পার্টি পার্লামেন্টারি গ্রুপ এবং কমনওয়েলথ মহাসচিব ছাড়াও যুক্তরাজ্য সরকার ও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা সাক্ষাৎ করেন।
যদিও সরকারি সফর হওয়ায় স্বাভাবিকভাবে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সাথে তার সাক্ষাৎ হওয়ার কথা থাকলেও এ সফরে সেটি হয়নি।
তবে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস যুক্তরাজ্যে যাওয়ার আগে ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সাথে তার একটি দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের কথা জানিয়েছিল, যদিও সেটি যে চূড়ান্ত তখনো হয়নি তাও তখন বলা হয়েছিল।
যুক্তরাজ্যে যাওয়ার পর ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ব্রিটেনে নেই বলে মন্তব্য করে আলোচনা সৃষ্টি করেন তার প্রেসসচিব শফিকুল আলম। পরে আবার তিনি জানিয়েছিলেন, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সাথে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক আয়োজনের জন্য কাজ হচ্ছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা আর হয়নি।
‘সফরটিকে সরকারি বলা হলেও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সাথে তার কোন বৈঠক হলো না কেন’- বিবিসির ‘দ্য ওয়ার্ল্ড টুনাইট’ অনুষ্ঠানে প্রচারিত সাক্ষাৎকারে এমন এক প্রশ্নের জবাবে ড. ইউনূস বলেছেন, ‘আমরা উনার (কিয়ার স্টারমারের) সঙ্গে দেখা করতে খুবই আগ্রহী ছিলাম। হয়ত তিনি ব্যস্ত ছিলেন বা অন্য কোনো কারণে তা সম্ভব হয়নি। তবে এতে করে আমার জন্য একটা বড় সুযোগও তৈরি হয়েছে। এখন যেহেতু তিনি ব্যস্ত, আমি তাকে বাংলাদেশে আসার আমন্ত্রণ জানাচ্ছি’।
বৈঠকের ব্যবস্থা না করার পেছনে কী কারণ দেখিয়েছে ডাউনিং স্ট্রিট (ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন)?- এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধান উপদেষ্টা ওই অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘আমার জানামতে, তারা তেমন কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি। হয়ত তিনি অন্য গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত’।
সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমদ বলছেন, সরকার প্রধান বিদেশে দ্বিপাক্ষিক সফরে যাওয়ার আগেই তার সব কর্মসূচি ও বৈঠকগুলো চূড়ান্ত হয়ে থাকে।
‘সব বিষয়ে দুই পক্ষের সমঝোতার পরেই এ ধরনের সফর হয়ে থাকে। কিন্তু যুক্তরাজ্য সফরে সেটি দেখা যায়নি,’ বলছিলেন তিনি।
মূলত, এ কারণেই অনেকে মনে করেন অধ্যাপক ইউনূসের এ সফরটিকে সরকারি বলা হলেও প্রকৃত অর্থে এই সফরের মূল কর্মসূচি ছিল ব্রিটেনের রাজার কাছ থেকে তার কিংস হারমনি অ্যাওয়ার্ড গ্রহণ করা এবং লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সাথে বৈঠক করা।
১৩ জুন শুক্রবার সকালে তারেক রহমান প্রধান উপদেষ্টার হোটেলে গিয়ে তার সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং এরপর যৌথ ঘোষণায় জানানো হয় যে আগামী সংসদ নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতেই হতে পারে বলে তারা একমত হয়েছেন।
এর আগে প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে নির্বাচনটি এপ্রিলের প্রথমার্ধে হবে বলে জানিয়েছিলেন।
সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলছেন, সরকার প্রধানের সরকারি সফরে ব্রিটেনে গিয়ে সে দেশের সরকার প্রধানের সাক্ষাৎ না পাওয়া এই সফরের একটি নেতিবাচক উপাদান। আর এ ধরনের সফরে গিয়ে দেশের রাজনীতি নিয়ে বৈঠক করা একটি নতুন ও আকর্ষণীয় উপাদান।
‘সফরটি একটি অস্বস্তি তৈরি করেছে। কূটনৈতিক প্রক্রিয়ায় এর একটা প্রতিক্রিয়া দেখা যাবে বলে আমি আন্দাজ করি,’ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
যদিও প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পাতায় যুক্তরাজ্য সফরের পাঁচটি অর্জনের কথা উল্লেখ করেছেন। এগুলো হলো:
১. রাজা চার্লসের কাছ থেকে একটি মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার গ্রহণ ও ব্রিটিশ রাজার সাথে ৩০ মিনিটের একান্ত (ওয়ান টু ওয়ান) বৈঠক।
২. দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের নেতার সাথে প্রধান উপদেষ্টার ‘ঐতিহাসিক’ সভা।
৩. যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সি (এনসিএ) সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এক শীর্ষ সহযোগীর ১৭০ মিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের সম্পদ জব্দ করেছে। এনসিএ কর্মকর্তারা বলেছেন, এটি সংস্থাটির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সম্পদ জব্দ।
৪. বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (এসিসি) প্রধানসহ বাংলাদেশ ও ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে ধারাবাহিক বৈঠক। সম্পদ পুনরুদ্ধারের জন্য আরও গভীর সহযোগিতার পথ তৈরি করতে এসব বৈঠক হয়েছে।
৫. রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের ব্যাপারে নতুন আশার সঞ্চার।
যদিও ব্রিটিশ রাজার প্রাসাদে অধ্যাপক ইইনূসকে অভ্যর্থনার ছবি প্রকাশ করলেও তাদের মধ্যকার আলাদা একান্ত বৈঠকের কোন ছবি বা প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি।
সাধারণত এ ধরনের বৈঠকের পর উভয় পক্ষ থেকেই বৈঠকের ছবি প্রকাশ করা হয়।
প্রধান উপদেষ্টার সফরসঙ্গী হিসেবে এ সফরে ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর ও দুর্নীতি দমন কমিশনের বা দুদক চেয়ারম্যান ড. আবদুল মোমেন।
মুন্সী ফয়েজ আহমদ বলছেন, টাকা উদ্ধারের আলোচনায় প্রধান উপদেষ্টার অংশ নেবার কথা নয় এবং সেটি হয়ও নি। ‘এটি কর্মকর্তাদের কাজ গভর্নর ও এসিসি চেয়ারম্যানসহ কর্মকর্তারা হয়ত সেটি করতে পারেন। এখানে প্রধান উপদেষ্টার কোন কাজ ছিল না,’ বলছিলেন তিনি।
লন্ডনেই এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব শফিকুল আলম নিজেই বলেছিলেন, "বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাজ্যে সে অর্থ পাচার হয়ে এসেছে, সেটিকে কীভাবে ফেরত আনা যায়- সেটি নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার সফরসঙ্গীরা কাজ করবেন’।
সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলছেন, সফরটিতে পেশাদারিত্বের ঘাটতি প্রকট হয়ে উঠেছে। "বাংলাদেশের বাস্তবতার আলোকে রাজনৈতিক বৈঠকটি হয়ত গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু সফরটি হলো কূটনৈতিক কাজ। সেই জায়গায় বাংলাদেশের অর্জন কতটা হলো কূটনৈতিক দিক থেকে সেটাই গুরুত্বপূর্ণ,’ বলছিলেন তিনি।
আর মুন্সী ফয়েজ আহমদ বলছেন, এ সফরে সরকারের অব্যবস্থাপনার চূড়ান্ত বহি:প্রকাশ ঘটেছে, যা পুরো সফরকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে বলে তিনি মনে করেন।
‘সরকারের দিক থেকে যা যা বলা হয়েছে এ সফর নিয়ে, তাতে স্বচ্ছতার প্রচণ্ড অভাব আছে। একটি দলের নেতার সাথে বৈঠক হয়ত রাজনীতিতে স্বস্তি এনেছে। কিন্তু সেজন্য প্রধান উপদেষ্টাকে এত বড় দল নিয়ে সেখানে যেতে হবে এটা কেমন কথা। আলোচনাটি গুরুত্বপূর্ণ ছিল কিন্তু সেটি অন্যভাবেও করা যেতো,’ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
আহমদ বলেন, প্রধান উপদেষ্টা এর আগেও যেসব বিদেশ সফরে গেছেন তার মধ্যে কতগুলো সত্যিকার অর্থে দ্বিপাক্ষিক সফর ছিল তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। ‘এগুলো তার এতদিনকার ভাবমূর্তির সঙ্গে মানানসই হয়নি। তিনি বা সরকার অদূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন’।
এদিকে অধ্যাপক ইউনূস যুক্তরাজ্য থেকে ফিরে আসার পরপরই তিনি লন্ডনের যে বিলাসবহুল হোটেলে প্রায় ৪০ জনসহ অবস্থান করেছেন, তার জন্য সরকারকে কি পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে সেটি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। সরকারের তরফ থেকে এ বিষয়ে এখনও কোনো ব্যাখ্যা এখনো আসেনি।