Logo

জাতীয়

জাতীয় নির্বাচন : সময়ের অপেক্ষা, নাকি সিদ্ধান্তের সংকট?

নুর মোহাম্মদ মিঠু

নুর মোহাম্মদ মিঠু

প্রকাশ: ১৭ জুন ২০২৫, ২০:৫২

জাতীয় নির্বাচন : সময়ের অপেক্ষা, নাকি সিদ্ধান্তের সংকট?

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে দেশের রাজনৈতিক উত্তেজনা এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে। আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে—ভোট আয়োজনের সময়, প্রক্রিয়া এবং প্রয়োজনীয় সংস্কার। নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে প্রস্তুতির ঘোষণা আসলেও চূড়ান্ত সময়সূচি নির্ধারণ এখনও সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে। 

সাংবিধানিক নিয়ম অনুযায়ী, জাতীয় সংসদের মেয়াদ শেষে ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করতে হয়। এই সময়সীমাকে সামনে রেখে নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী ৫৫ থেকে ৬৬ দিনের মধ্যেই হতে পারে দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই রাজনৈতিক লড়াই। তবে কমিশনের হাতে সময়সূচি ঘোষণার ক্ষমতা না থাকায় তারা আপাতত সরকারের দিকেই তাকিয়ে আছে। 

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, নির্বাচন কমিশন প্রস্তুত থাকলেও সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া ভোট অনুষ্ঠান সম্ভব নয়। কমিশনের একটি সূত্র বলছে, প্রশাসনিক প্রস্তুতি শেষ পর্যায়ে, কিন্তু ভোটের ক্যালেন্ডার চূড়ান্ত করতে প্রয়োজন সরকারের সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত।

এদিকে রাজনৈতিক দলগুলোও এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করেনি, যা পরিস্থিতিকে আরও অনিশ্চিত করে তুলেছে।

সম্প্রতি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে লন্ডনে সাক্ষাৎ করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এই সাক্ষাতের পর নির্বাচনের সময়সূচি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতানৈক্য আরও গভীর হয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন আয়োজনের সম্ভাবনার খবরে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নতুন করে আপত্তি জানিয়েছে। এর ফলে রাজনৈতিক সমঝোতা অর্জন আরও কঠিন হয়ে পড়েছে।

জটিলতার কারণে ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় দফা সংলাপেও জামায়াত অংশ নেয়নি। যদিও শুরু থেকেই বিএনপি নির্বাচন চেয়ে আসছিল, বর্তমানে তারাও বলছে—তারিখ ঘোষণার আগ পর্যন্ত ধৈর্য ধরতে হবে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘অস্থিরতার মধ্যে সারাক্ষণ থাকলে চলবে না। ধৈর্য ধরতে হবে, সহনশীল হতে হবে। আমাদের মধ্যে আস্থার একটি জায়গা থাকতে হবে। আমরা যদি একেবারে আস্থাহীন হয়ে যাই, তাহলে সমস্যা। জাতি গণতান্ত্রিক পথে চলছে, আমরা সঠিক পথেই এগোচ্ছি। একটা সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র ফিরে আসবে, এতটুকু আস্থা আমাদের রাখা উচিত।’

নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার জানান, ‘সরকার নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই নির্বাচন আয়োজন করতে কমিশনের সক্ষমতা আছে। তবে প্রয়োজন রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছা।’ 

তবে নির্বাচন ঘিরে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার এখনো অনিষ্পন্ন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য তিনটি ইস্যু হলো—প্রবাসী ভোটারদের ভোটাধিকার, নারী ভোটারের প্রতিনিধিত্ব এবং নির্বাচনী সীমানা পুনর্বিন্যাস। 

প্রায় এক কোটি প্রবাসীর ভোটাধিকার থাকলেও, তাদের ভোটগ্রহণের জন্য কোনো নির্দিষ্ট পদ্ধতি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। জাতীয় জনসংখ্যায় নারীর সংখ্যা পুরুষের তুলনায় বেশি হলেও ভোটার তালিকায় তারা পিছিয়ে। পাশাপাশি সংরক্ষিত নারী আসন পুনর্বিবেচনার দাবি উঠেছে। এছাড়া জনসংখ্যা পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে নির্বাচনী এলাকার সীমানা পুনর্বিন্যাস না হওয়ায় আসন বণ্টনের ভারসাম্য নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। 

বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচন কমিশনের আনুষ্ঠানিক প্রস্তুতি প্রায় শেষ হলেও, পরিস্থিতি এখন নির্ভর করছে তিনটি বিষয়ের ওপর—সরকারের সিদ্ধান্ত, প্রয়োজনীয় নির্বাচন সংস্কার এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ এবং কূটনৈতিক চাপ পরিস্থিতিকে আরও স্পর্শকাতর করে তুলেছে।

সবমিলিয়ে বলা যায়, জাতীয় নির্বাচন এখন আর কেবল সময়ের প্রশ্ন নয়—এটি হয়ে উঠেছে একটি রাজনৈতিক পরীক্ষা। যেখানে নির্বাচন কমিশন প্রস্তুত, জনগণ অপেক্ষায়, কিন্তু দরকার সরকারের সাহসী সিদ্ধান্ত ও রাজনৈতিক ঐক্যের বাস্তবায়ন।

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেবল আর একটি নির্বাচন নয়, এটি হতে যাচ্ছে গণতন্ত্রের মানদণ্ড রক্ষার এক গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা। এখন প্রশ্ন হলো—ভোটের ঘণ্টা বাজবে সময়মতো? নাকি সিদ্ধান্তহীনতার ভারে আবারও পিছিয়ে পড়বে বাংলাদেশ?

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

নির্বাচন নির্বাচন কমিশন অন্তর্বর্তী সরকার

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর