-685e24988cde1.jpg)
একটি দীর্ঘ রাজনৈতিক অস্থিরতা পেরিয়ে দেশ যখন একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে স্থিতিশীলতার স্বপ্ন দেখছে, তখন নির্বাচনের রোডম্যাপ এবং সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে নতুন করে ঘনীভূত হচ্ছে সংশয়ের মেঘ। বিশেষ করে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে সরকারের সামনে এখন তিন চ্যালেঞ্জ।
বিএনপির তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি, জামায়াতের নিরপেক্ষতার শর্ত এবং ছোট দলগুলোর সহিংসতার আশঙ্কা- এই তিন সুরকে সামঞ্জস্য করাই এখন সরকারের জন্য বড় পরীক্ষা। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, জুলাই সনদ যদি স্পষ্ট রোডম্যাপ দেয়, তাহলে পরিস্থিতি কিছুটা স্বচ্ছ হবে। অন্যথায়, বাংলাদেশ নির্বাচন-পূর্ব অস্থিরতা ও আন্তর্জাতিক চাপের মুখোমুখি হতে পারে। সরকার ও বিরোধী দলগুলোর মধ্যে ন্যূনতম ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হলেও, এর উপদেষ্টা পরিষদের স্বচ্ছতা, কার্যকারিতা এবং চূড়ান্ত লক্ষ্য নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে চলছে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা।
একদিকে বিএনপি এই সরকারকে পুরোপুরি ‘তত্ত্বাবধায়ক আদলে’ দেখতে চায়, অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী ও অন্য দলগুলো বর্তমান কাঠামোতেই আস্থা রাখতে রাজি, তবে জুড়ে দিয়েছে কঠোর শর্ত। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে লন্ডনে অনুষ্ঠিত এক রহস্যময় বৈঠক এবং বহু প্রতীক্ষিত ‘জুলাই সনদ’, যা বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যৎ গতি-প্রকৃতি নির্ধারণে নিয়ামক ভূমিকা পালন করতে পারে। সব মিলিয়ে দেশ একটি নির্বাচনি টানেলে প্রবেশ করেছে বলে মনে হলেও, পথটি এখনো কুসুমাস্তীর্ণ নয়।
উপদেষ্টা পরিষদ নিয়ে মূল বিতর্ক: সংস্কার বনাম নির্বাচন
অন্তর্বর্তী সরকারের কাঁধে দুটি বড় দায়িত্ব, একটি হলো নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ পরিবেশ নিশ্চিত করা এবং অন্যটি হলো রাষ্ট্রীয় কাঠামোর প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধন করা। এই দুই দায়িত্বের অগ্রাধিকার নিয়েই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তৈরি হয়েছে মৌলিক পার্থক্য।
বিএনপির অবস্থান বেশ স্পষ্ট। দলটি মনে করে, যেহেতু দেশ নির্বাচনের দিকে এগোচ্ছে, তাই সরকারের উচিত অবিলম্বে ‘কেয়ারটেকার মোডে’ চলে যাওয়া। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর মতে, উপদেষ্টা পরিষদের কয়েকজন সদস্য এরই মধ্যে তাদের কথাবার্তা ও কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বিতর্কিত হয়েছেন। তাদের পদে রেখে সরকারের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে, যা একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে প্রধান অন্তরায়। তিনি বলেন, ‘যদি সরকারের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হয় তাহলে সামনের দিকে এগোনোর কোনো সুযোগ নেই... যেহেতু আমরা নির্বাচনের দিকে যাচ্ছি সরকারকে এখন কেয়ারটেকার মোডে যেতে হবে।’ বিএনপির এই দাবি মূলত নির্বাচনকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে একটি স্বচ্ছ ভোটের পরিবেশ তৈরির দিকেই ইঙ্গিত করে।
তবে এই দাবির সঙ্গে পুরোপুরি একমত নয় জামায়াতে ইসলামী এবং জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। জামায়াত মনে করে, বর্তমান উপদেষ্টা পরিষদকে দিয়েই একটি সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব। তবে সেজন্য সরকারকে কাজের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত নিরপেক্ষতার প্রমাণ দিতে হবে। দলের কেন্দ্রীয় প্রচার বিভাগের সেক্রেটারি মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, নিরপেক্ষতার প্রমাণ রাখতে হবে। কাজের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত এই নিরপেক্ষতা প্রমাণ করতে হবে। যদি তারা বিশেষ দলের প্রতি ঝুঁকে পড়েন বা তাদের কাজ এমন হয় সেক্ষেত্রে তো নিরপেক্ষতা হারাবে। অর্থাৎ, জামায়াত উপদেষ্টাদের পরিবর্তনের চেয়ে তাদের কর্মের ওপরই বেশি জোর দিচ্ছে।
অন্যদিকে এনসিপি মনে করে, সরকারের এখনই পুরোপুরি নির্বাচনমুখী হওয়ার সময় আসেনি। তাদের মতে, যে কাঠামোগত সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে এই সরকার এসেছিল, সেটি আগে সম্পন্ন করা প্রয়োজন। দলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, যে রিফরমেশনের কথা বলা হয়েছিল... সেই জায়গা যদি গ্রহণযোগ্য করে ফেলতে পারে তাহলে উপদেষ্টা কমানো বাড়ানো সেগুলো প্রয়োজন অনুযায়ী অন্তর্বর্তী সরকার সিদ্ধান্ত নিবে। তাদের এ অবস্থান বলছে, একটি টেকসই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য শুধু একটি নির্বাচনই যথেষ্ট নয়, বরং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কারও জরুরি।
এদিকে বিতর্কের এই আবহে এবি পার্টি একটি গুরুত্বপূর্ণ বাস্তবতার দিকে আঙুল তুলেছে। তাদের মতে, একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য কেবল সরকারের নিরপেক্ষতাই যথেষ্ট নয়; বড় রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিরপেক্ষ ভূমিকাও অপরিহার্য। দলের চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান ভূঁইয়া মঞ্জু আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলগুলো যদি নির্বাচনের মাঠে অন্য দলগুলোকে বাধা দেয় বা ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করে এবং প্রশাসন যদি সেখানে সঠিকভাবে হস্তক্ষেপ করতে না পারে, তাহলে নির্বাচন নিয়ে সংশয় থেকেই যাবে। তার এই বক্তব্য স্মরণ করিয়ে দেয় যে, বাংলাদেশের নির্বাচনের ইতিহাস শুধু প্রশাসনিক কারসাজির নয়, মাঠ পর্যায়ের পেশিশক্তির প্রদর্শনেরও। তাই একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য একটি বহুমাত্রিক সহযোগিতামূলক পরিবেশ অনস্বীকার্য।
লন্ডন বৈঠক ও ‘জুলাই সনদ’: রহস্যের অন্তরালে ভবিষ্যৎ
বর্তমান রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে সম্প্রতি লন্ডনে অনুষ্ঠিত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার মধ্যকার একটি বৈঠক। এই 'একান্ত আলাপে' ঠিক কী কথা হয়েছে, তা এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়নি। এই গোপনীয়তা রাজনৈতিক মহলে নানা জল্পনা-কল্পনার জন্ম দিয়েছে। তবে এই বৈঠক যে ফলপ্রসূ হয়েছে এবং এর ফলেই বিএনপি নির্বাচনি প্রক্রিয়া নিয়ে আশাবাদী হয়ে উঠেছে, সে বিষয়ে বেশির ভাগ দলই একমত। এই বৈঠকের পরই বিএনপি নেতারা বলতে শুরু করেছেন যে, দেশ নির্বাচনি টানেলে প্রবেশ করেছে। এটি ইঙ্গিত দেয় যে, পর্দার আড়ালে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে এমন কোনো সমঝোতা হয়েছে, যা আগামী দিনের রাজনীতির গতিপথ নির্ধারণ করে দেবে।
এই রহস্যময় বৈঠকের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে ‘জুলাই সনদ’-এর প্রত্যাশা। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই সনদটি প্রকাশিত হলে অন্তর্বর্তী সরকারের করণীয়, নির্বাচনি রোডম্যাপ এবং ক্ষমতার ভারসাম্য অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে যাবে। এই সনদটি কি সব দলের অংশগ্রহণে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের পথ তৈরি করবে, নাকি এটি কোনো নির্দিষ্ট পক্ষের স্বার্থ রক্ষা করে নতুন করে বিতর্কের জন্ম দেবে, সেই উত্তর পেতেই এখন রাজনৈতিক অঙ্গন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।
বাংলাদেশের রাজনীতি এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। অন্তর্বর্তী সরকার একটি ভঙ্গুর আস্থার ওপর ভর করে পথ চলছে। উপদেষ্টা পরিষদ নিয়ে বিতর্ক, সংস্কারের অগ্রাধিকার নির্ধারণ এবং মাঠ পর্যায়ে সব দলের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করার মতো কঠিন চ্যালেঞ্জ তাদের সামনে। বিএনপি চাইছে দ্রুততম সময়ে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আদলে নির্বাচন, আর অন্য দলগুলো চাইছে কর্মের মাধ্যমে সরকারের নিরপেক্ষতার প্রমাণ অথবা প্রতিশ্রুত সংস্কার বাস্তবায়ন।
এই আস্থা-অনাস্থার দোলাচলের মধ্যে 'লন্ডন বৈঠক' একটি আশার আলো দেখালেও, এর অস্পষ্টতা এক ধরনের ধোঁয়াশাও তৈরি করেছে। চূড়ান্তভাবে, 'জুলাই সনদ'ই সম্ভবত এই ধোঁয়াশা কাটাতে পারে। তবে এর সাফল্য নির্ভর করবে এটি সব রাজনৈতিক দলের কাছে কতটা গ্রহণযোগ্য হবে, তার ওপর। যদি এই সনদ একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের রূপরেখা দিতে পারে এবং সরকার যদি তার প্রতিটি পদক্ষেপে নিরপেক্ষতার প্রমাণ রাখতে পারে, তবেই বাংলাদেশ একটি সফল নির্বাচনের মাধ্যমে স্থিতিশীলতার পথে ফিরতে পারবে। অন্যথায়, আস্থার সংকট আরও ঘনীভূত হয়ে দেশকে আবারও রাজনৈতিক সংঘাতের দিকে ঠেলে দিতে পারে, যা কারোরই কাম্য নয়। জাতি এখন একটি টেকসই সমাধানের প্রত্যাশায় তাকিয়ে আছে রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার দিকে।
- এটিআর