বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুলের ম্যুরাল ভাঙচুরের প্রতিবাদে ৫২ বিশিষ্টজনের নিন্দা

বাংলাদেশের প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৮ জুন ২০২৫, ১৬:৫৯

বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলামের ভাঙা ম্যুরালের ছবি
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের অন্যতম রূপকার ও বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলামের স্মরণে কুমিল্লা কালেক্টরেট স্কুল অ্যান্ড কলেজের পাশে নির্মিত ম্যুরাল ভাঙচুরের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ ও তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন দেশের ৫২ জন বিশিষ্ট নাগরিক। তারা এক যুক্ত বিবৃতিতে এ ঘটনাকে শুধু একটি শিল্পকর্মের ওপর হামলা নয়, বরং ভাষা শহীদদের অবমাননা এবং দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিবোধের বিরুদ্ধে পরিচালিত চক্রান্ত হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
শনিবার (২৮ জুন) দেওয়া এই বিবৃতিতে বলা হয়, রফিকুল ইসলাম ছিলেন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতির অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা। তাঁর চিন্তা ও উদ্যোগেই ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। সেই কর্মবীরের স্মরণে নির্মিত ম্যুরাল ভাঙার মধ্য দিয়ে জাতিগত গৌরব ও মানবিক বিবেককে আহত করা হয়েছে।
বিবৃতিতে অভিযোগ করা হয়, কুমিল্লায় জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে স্থাপিত ম্যুরালটি ভাঙচুরের পরও প্রশাসন নিরব ভূমিকা পালন করেছে। একই সঙ্গে বিজয় সরণির ‘মৃত্যুঞ্জয়ী প্রাঙ্গণ’ এলাকায় সাতটি স্থাপনা ভেঙে সেখানে ‘জুলাই গণমিনার’ নির্মাণের পরিকল্পনারও সমালোচনা করা হয়। বিবৃতিদাতাদের মতে, ‘জুলাই চেতনাকে ধারণ করার জন্য অন্য কোনো উন্মুক্ত স্থানে প্রতীক নির্মাণ সম্ভব ছিল; পূর্বস্থিত জাতীয় ঐতিহ্য ভেঙে নতুন বিতর্ক তৈরি করার প্রয়োজন ছিল না।’
তারা বলেন, মুক্তিযুদ্ধ ও ভাষা আন্দোলনের স্মারক আমাদের অহংকারের প্রতীক। এসব রক্ষা করা প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব। প্রশাসনের এই ‘হীরন্ময় নিরবতা’ বীর সন্তানদের প্রতি অসম্মান এবং জাতীয় চেতনার প্রতি অবজ্ঞার শামিল।
বিবৃতিদাতারা দোষীদের দ্রুত শনাক্ত করে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান।

নিন্দা জানানো বিশিষ্টজনরা হলেন-
১. এম এম আকাশ, অর্থনীতিবিদ
২. বীর মুক্তিযোদ্ধা ড. নুরুন নবী, একুশে পদকপ্রাপ্ত লেখক
৩. বীর মুক্তিযোদ্ধা ইসহাক খান, কথাসাহিত্যিক
৪. জাকির তালুকদার, কথাসাহিত্যিক
৫. সালাহউদ্দিন বাদল, কবি ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
৬. অজয় দাশগুপ্ত, সাংবাদিক ও লেখক
৭. বীর মুক্তিযোদ্ধা তাজুল ইমাম, বিশিষ্ট শিল্পী
৮. বীর মুক্তিযোদ্ধা ফরিদুর রহমান, কথাশিল্পী ও বিটিভির সাবেক ডিডিজি
৯. ড. মকবুল হোসেন, রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী
১০. শাহেদ কায়েস, কবি ও মুক্তচিন্তক
১১. সরকার আবদুল মান্নান, কবি ও প্রাবন্ধিক
১২. সন্তোষ রায়, কবি ও প্রাবন্ধিক
১৩. শওগাত আলী সাগর, প্রবাসী সাংবাদিক
১৪. রফিকুর রশীদ, কথাসাহিত্যিক
১৫. ঝর্ণা রহমান, কথাসাহিত্যিক
১৬. সেজান মাহমুদ, কথাসাহিত্যিক ও চিকিৎসাবিজ্ঞানী
১৭. ডা. আতিকুল হক, চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ
১৮. ড. মুকিদ চৌধুরী, কথাসাহিত্যিক ও গবেষক
১৯. হোসেন দেলওয়ার, কবি
২০. মোজাম্মেল হক নিয়োগী, কথাসাহিত্যিক
২১. গোলাম মোর্শেদ চন্দন, কবি
২২. মোহাম্মদ আনওয়ারুল কবীর, কবি, গল্পকার ও অধ্যাপক
২৩. হামীম কামরুল হক, কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষক
২৪. শামীম আশরাফ, শিক্ষক
২৫. স্বকৃত নোমান, কথাসাহিত্যিক
২৬. আরিফ নজরুল, কবি ও প্রাবন্ধিক
২৭. ড. মোহাম্মদ মাহমুদ হাসান, অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর, আইন ও লিগ্যাল স্টাডিজ বিভাগ, কার্লটন ইউনিভার্সিটি, কানাডা
২৮. মনি হায়দার, কথাসাহিত্যিক
২৯. সরদার ফারুক, কবি
৩০. ফজলুল কবিরী, কথাসাহিত্যিক ও সাহিত্য-সমালোচক
৩১. আবদুল্লাহ আল ইমরান, কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
৩২. শফিক হাসান, কথাসাহিত্যিক ও ছোটকাগজ সম্পাদক
৩৩. আলমগীর মাসুদ, কবি ও সম্পাদক
৩৪. ড. মাসুদ পথিক, কবি ও চলচ্চিত্র নির্মাতা
৩৫. আরিফুর রহমান, কথাসাহিত্যিক
৩৬. মেহেদী হাসান শোয়েব; লেখক, প্রকাশক ও সাংবাদিক
৩৭. আবদুল্লাহ আল মামুন, পিএইচডি গবেষক, কানাডা
৩৮. শামস সাইদ, কথাসাহিত্যিক
৩৯. বিনয় কর্মকার, কবি
৪০. সালাহ উদ্দিন মাহমুদ, কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
৪১. মিলন সব্যসাচী, কবি
৪২. এ কে এম মাহতাব ঊদ্দীন, মানবাধিকার কর্মী
৪৩. গিরীশ গৈরিক, কবি ও সাংবাদিক
৪৪. সমর চক্রবর্তী, কবি ও সাংবাদিক
৪৫. পিকলু চৌধুরী, নির্মাতা
৪৬. গোলাম মুজতবা মর্তুজা, সাংবাদিক
৪৭. নিশাত বিজয়, সাংবাদিক
৪৮. জহিরুল হক বাপি, লেখক
৪৯. নাদিম ইকবাল, চিত্রপরিচালক
৫০. অনিরুদ্ধ দিলওয়ার, কবি ও ছোটকাগজ সম্পাদক
৫১. রাফায়েত চৌধুরী, সমাজচিন্তক ও সংগঠক
৫২. রাশিদা স্বরলিপি, কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
প্রসঙ্গত, কুমিল্লা কালেক্টরেট স্কুল অ্যান্ড কলেজ লাগোয়া শহীদ মিনার ও বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলামের ম্যুরাল ভাঙা হয়েছে, এমন ছবি গত বুধবার (২৫ জুন) ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে এ নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়। এ ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা। তাঁরা দ্রুততম সময়ের মধ্যে শহীদ মিনার সংস্কার ও ম্যুরালটি আবার নির্মাণের দাবি জানান।
কুমিল্লার জেলা প্রশাসক মো. আমিরুল কায়ছার গণমাধ্যমকে বলেন, বীর মুক্তিযোদ্ধার ম্যুরাল এবং পাশে থাকা শহীদ মিনার ভেঙে ফেলার বিষয়টি তিনি জেনেছেন। তবে কখন বা কারা এগুলো ভেঙেছে, সেটি এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এগুলো আবারও পুনর্নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হবে। এ ছাড়া কারা এ ঘটনায় জড়িত, তা খতিয়ে দেখার চেষ্টা চলছে।
জানা গেছে, কুমিল্লা নগরের রাজবাড়ি এলাকায় কালেক্টরেট স্কুল অ্যান্ড কলেজের পাশে বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলামের পরিবারের উদ্যোগে ও জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে এই শহীদ মিনার এবং ম্যুরাল স্থাপন করা হয়। ২০১৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি এটি উদ্বোধন করেন তৎকালীন কুমিল্লার জেলা প্রশাসক (ডিসি) হাসানুজ্জামান কল্লোল ও বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলামের স্ত্রী বুলি ইসলাম। ম্যুরালের পাশেই রফিকুল ইসলামের পৈত্রিক বাড়ি।
কুমিল্লা জেলার মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৯৮ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব কফি আনানকে একটি চিঠি লেখেন। চিঠিতে তিনি ১৯৫২ সালে ভাষাশহীদদের অবদানের কথা উল্লেখ করে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তাব করেন। রফিক তাঁর সহযোদ্ধা আবদুস সালামকে নিয়ে ‘এ গ্রুপ অব মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ নামে একটি সংগঠন দাঁড় করান এবং অন্যান্য সদস্যরাষ্ট্রের সমর্থনের আদায়ের চেষ্টা শুরু করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেসকো জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি দেয়। ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে দিবসটি জাতিসংঘের সদস্যদেশগুলোতে পালিত হচ্ছে। এ গৌরবময় অবদানের জন্য ২০০২ সালে তাঁদের সংগঠন একুশে পদক লাভ করে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের অন্যতম রূপকার বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম দীর্ঘদিন ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করে ২০১৩ সালের ২১ নভেম্বর কানাডার একটি হাসপাতালে নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।