হোলি আর্টিজানে হামলা
‘স্মৃতি মুছে গেছে’ নৃশংস সেই রাতের, ভাঙা ‘দিপ্ত শপথে’ একদল শিক্ষার্থী

বাংলাদেশের প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০২ জুলাই ২০২৫, ২১:১৮

ভেঙে ফেলা ‘দিপ্ত শপথ’ ভাস্কর্যে শহিদ দুই পুলিশ সদস্যের ছবি সংবলিত শোক ব্যানার স্থাপন করে পুষ্পস্তবক অর্পণ কর্মসূচি পালন করে একদল সাধারণ শিক্ষার্থী
রাজধানীর গুলশানে হোলি আর্টিজান বেকারিতে ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে ভয়াবহ জঙ্গি হামলা চালানো হয়। দেশি-বিদেশি অতিথিদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে নির্মমভাবে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করে ২০ জনকে। নিহতদের মধ্যে ইতালির ৯ জন, জাপানের ৭ জন, ভারতের ১ জন এবং বাংলাদেশের ৩ জন নাগরিক ছিলেন। এছাড়া জিম্মিদের মুক্ত করতে অভিযান চালাতে গিয়ে জঙ্গিদের বোমা হামলায় নিহত হন পুলিশের দুই কর্মকর্তা।
নৃশংস এ হত্যাযজ্ঞের দিনটি স্মরণ ও নিহত দুই পুলিশ কর্মকর্তার স্মরণে নির্মিত ভাস্কর্য ‘দিপ্ত শপথ’ গত বছরের ৬ আগস্ট ভেঙে ফেলা হয়। সেখানে টাঙিয়ে দেওয়া হয় নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হিজবুত তাহরীরের পোস্টার। এরপর এখনো ভাস্কর্য মেরামত করা হয়নি। এমনকি প্রতিবছরের মতো এবার রাষ্ট্রীয়সহ দলমত নির্বিশেষে ১ জুলাই সেখানে শ্রদ্ধা জানানোর কোনো আয়োজন করেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
এরই জেরে আজ বুধবার (২ জুলাই) গুলশানে ভেঙে ফেলা সেই ভাস্কর্যের জায়গায় শহিদ দুই পুলিশ সদস্যের ছবি সংবলিত শোক ব্যানার স্থাপন করে পুষ্পস্তবক অর্পণ কর্মসূচি পালন করেছে একদল সাধারণ শিক্ষার্থী।

শিক্ষার্থীরা জানান, বুধবার বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে গুলশানে গুলশানে ভেঙে ফেলা সেই ভাস্কর্যের সামনে যান তারা। পরে সেখানে তারা হোলি আর্টিজান বেকারিতে জিম্মি উদ্ধার অভিযানে শহিদ তৎকালীন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার (এসি) রবিউল করিম ও বনানী থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সালাহউদ্দিনের ছবি সংবলিত শোক ব্যানার স্থাপন করেন। পরে তারা পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শহিদ দুই পুলিশ কর্মকর্তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
তারা জানান, ব্যানার লাগানোর সময় একজন কনস্টেবল অনুমতি নেওয়া হয়েছে কি না জানতে চেয়েছিলেন। পরে শিক্ষার্থীরা গুলশান থানার ২য় তলায় ডিউটি অফিসারের কাছে গিয়ে তাকে পাননি। পরে তিনি ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছে গেলে ওই কর্মকর্তা ‘ভাস্কর্য ঠিক করতে এসেছেন কি না’ জানতে চান। এ সময় তিনি ‘ঠিক করতে নয়, শ্রদ্ধা জানাতে এসেছেন এবং অনুমতি পেলে এক মাসের মধ্যে ঠিক করা হবে’ বলে ওসিকে জানান। ওই কর্মকর্তা বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অবহিত করবেন বলে জানান। এরপর শিক্ষার্থীরা নিচে এসে ভাস্কর্যের ওই স্থানে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন।

শিক্ষার্থ শাহরিয়ার ইব্রাহীম বলেন, ২০১৬ সালে হোলি আর্টিজানে কাপুরুষোচিত হামলা চালিয়েছিল জঙ্গিরা। সেই জঙ্গিদের হামলা প্রতিহত করার জন্য আমাদের অকুতোভয় পুলিশ কর্মকর্তারা সেখানে যান ও তাদের প্রতিহত করার চেষ্টা করেন। প্রতিহত করার চেষ্টাকালে আমাদের দুইজন অকুতোভয় পুলিশ সদস্য নিহত হন। প্রতি বছরের মতো এবারও আমরা শ্রদ্ধা জানাতে এসেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় ও অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, প্রতি বছরের মতো পুলিশ এখানে কোনো প্রকার কর্মসূচি গ্রহণ করেনি।
তিনি বলেন, ২০২৪ সালের ৬ আগস্ট তাদের স্মরণে যে ভাস্কর্য বানানো হয়েছিল, সেটি ভাঙচুর করে হিজবুত তাহরীর এবং এখানে পোস্টার টাঙিয়ে যায়। এরপর থেকে প্রায় এক বছর কেটে গেলেও তা এখনো ভাস্কর্য পুর্নস্থাপন করার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। যদি পুলিশ আমাদের অনুমতি দেয়, আমরা সেটি করব। কারণ, এই শহীদেরা আমাদের অনুপ্রেরণা। আমরা তাদের সবসময় স্মরণ করতে চাই। তাদের পরিচয় ছিল দায়িত্বশীল-মানবিক পুলিশ কমকর্তা। আমরা তাদের আত্ম বলিদানকে স্মরণ করতে চাই। সকল পুলিশ সদস্যরা যাতে তাদের আত্ম বলিদানে বলিষ্ঠ হয়ে মানবসেবায় নিজেদের নিয়োজিত করেন সেই আহ্বান রইল।

কী ঘটেছিল সেই রাতে?
হোলি আর্টিজানে যখন হামলা হয়, তখন রোজার মাস চলছিল। ঘটনার রাতটি নির্ঘুম কাটে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সংবাদ কর্মীসহ কোটি কোটি মানুষের। নজিরবিহীন সেই রাতে সবার চোখ আটকে ছিল টেলিভিশনের পর্দায়। ভেতরের পরিস্থিতি জানতে এবং নিয়ন্ত্রণে আনতে নানা পরিকল্পনা চলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের। শীর্ষ কর্মকর্তারা দফায় দফায় বৈঠক করেন। কিন্তু সময় গড়িয়ে গেলেও কোনো সিদ্ধান্তে আসতে না পারায় সেনাবাহিনী ডাকা হয়। পরদিন সূর্য ওঠার আগে শুরু হয় সেনাবাহিনীর কমান্ডো অভিযান। সেই অভিযানে হোলি আর্টিজানের নিয়ন্ত্রণ নেয় কমান্ডোরা, পাঁচ জঙ্গির মৃত্যুর মধ্য দিয়ে রুদ্ধশ্বাস সংকটের অবসান ঘটে।
নিহত সেই ৫ জঙ্গি হলেন– নিবরাজ ইসলাম, শফিকুল ইসলাম ওরফে উজ্জ্বল, মীর সামেহ মোবাশ্বের, রোহান ইবনে ইমতিয়াজ ও খায়রুল ইসলাম ওরফে পায়েল। ধীরে ধীরে জানা যায়, হোলি আর্টিজানে হামলার বেশ কিছুদিন আগেই তারা বাসা থেকে বেরিয়ে নিরুদ্দেশ হয়েছিল। তাদের কারো কারো পরিবার থানায় জিডিও করেছিল। গুলশানের কূটনৈতিক পাড়ায় ওই ঘটনা বিশ্বকে চমকে দিয়েছিল। দেড় ডজন বিদেশি নাগরিক নিহত হওয়ায় আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোও বড় পরিসরে সেই খবর প্রকাশ করে।
জিম্মিদের মুক্ত করতে অভিযান পরিচালনার সময় বোমা হামলায় নিহত হন বনানী থানার তৎকালীন ওসি সালাহউদ্দিন খান এবং ডিবির সহকারী কমিশনার (এসি) রবিউল ইসলাম।

হোলি আর্টিজেন হামলার পর গুলশান থানায় দায়ের করা মামলার বিচার চলে প্রায় সাড়ে তিন বছর। পুলিশ ওই ঘটনায় কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করে। ২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনাল সাতজনের ফাঁসির রায় দেয়। কিন্তু ২০২৩ সালের ৩০ অক্টোবর ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের রায়ে ওই সাতজনের সাজা পাল্টে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেন হাইকোর্ট।
আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত সাত আসামি হলেন রাকিবুল হাসান ওরফে রিগ্যান, মো. জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে রাজীব গান্ধী, আসলাম হোসেন ওরফে র্যাশ, হাদিসুর রহমান, আবদুস সবুর খান ওরফে সোহেল মাহফুজ, মামুনুর রশীদ ওরফে রিপন ও শরিফুল ইসলাম খালেদ। এদের মধ্যে আসলাম হোসেন গত বছরের ৬ জুন গাজীপুরের কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগারে কারারক্ষীদের গুলিতে নিহত হন। গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরদিন ওই কারাগারে কারারক্ষীদের জিম্মি করে ২০৯ জন বন্দী পালিয়ে যান। তখন কারারক্ষীদের গুলিতে মোট ৬ জন নিহত হন।

হোলি আর্টিজান হামলার সেই রাতেই এর দায় স্বীকার করে আন্তর্জাতিক উগ্রবাদী সংগঠন ইসলামিক স্টেট-আইএস। তবে বাংলাদেশের গোয়েন্দারা তা নাকচ করে সে সময় বলেন, বাংলাদেশি জঙ্গিদের একটি সংগঠিত ধারাই এই হামলা চালিয়েছে, যার নাম দেওয়া হয় ‘নব্য জেএমবি’।
হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার দিনটিকে স্মরণ করে প্রতি বছর গুলশান থানায় নিহত দুই পুলিশ কর্মকর্তার স্মরণে নির্মিত ভাস্কর্য ‘দীপ্ত শপথ’-এ পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করে শ্রদ্ধা জানাতেন ঊধ্বর্তন পুলিশ কর্মকর্তারা। গুলশানের ৭৯ নম্বর সড়কের যে বাড়িটিতে বেকারিটি ছিল, সেই ৫ নম্বর বাড়িতে প্রতি বছরের ১ জুলাই ইতালি, জাপান ও মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তাদের শ্রদ্ধা জানানোর রেওয়াজ চালু হয়েছিল। তবে এবার এ ধরনের কোনো কর্মসূচি নেই বলে জানিয়েছিলেন ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (মিডিয়া) তালেবুর রহমান।
এখন হোলি আর্টিজানের সেই পুরোনো ঠিকানায় আগের মতো কোনো রেস্তোরাঁ নেই। জায়গাটির মালিকপক্ষ পরবর্তী সময়ে রেস্তোরাঁটি আর চালু না করার সিদ্ধান্ত নেয়। বর্তমানে সেটি একটি আবাসিক ভবনে রূপান্তরিত হয়েছে। তবে ভবনের দেয়ালের ভেতর আজও জমে থাকা স্মৃতি কেউ কেউ ভুলতে পারেননি।
এমএএস/এইচকে