
হাসপাতালে এখনো ভর্তি জুলাই আন্দোলনে আহত একজন। ছবি : সংগৃহীত
মেরুদণ্ডের হাড়ে এখনও বুলেটবিদ্ধ তরুণ। অভ্যুত্থানের এগারো মাসেও উন্নত চিকিৎসা, সরকারি অনুদান, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমআইএস কিংবা মন্ত্রণালয়ের গেজেট কোথাও নেই তিনি।
ঋণগ্রস্ত হয়ে মারাত্মক আর্থিক দুরাবস্থায় পড়েছেন। একমাত্র সন্তানকে নিয়ে চলে গেছে স্ত্রী। ৫ আগস্টের পর ১১ মাসে শ্রিপুরের একজন ‘জুলাই যোদ্ধা’র এ হলো পরিস্থিতি। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহত এ তরুণের নাম মো. শাকিল। খবর বিবিসি’র।
গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার শাকিল জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনের তালিকায়ও অনুপস্থিত। চিকিৎসা ওষুধপত্রের পেছনে খরচা মিলিয়ে সাড়ে তিন লাখ টাকার মতো ঋণগ্রস্ত বলে তিনি বিবিসি বাংলাকে জানান।
‘আমার লাইফটাই এলোমেলো হয়ে গেছে। আমার সংসারটা এলোমেলো হয়ে গেছে। সবকিছু শেষ। আমার সব শেষ।’
৫ আগস্ট মাওনা এলাকায় বুলেট কোমরের উপর থেকে ঢুকে মেরুদণ্ডের হাড়ে বিঁধে যায়। এক্সরে ছবিতে এখনও সেই বুলেট স্পষ্ট দেখা যায়। শাকিল জানান, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে তার চিকিৎসা হয়েছে।
সেখান থেকে সেপ্টেম্বর মাসে তাকে রিলিজ দেওয়া হয়। কিন্তু তার শরীর থেকে গুলিটি বের করা হয়নি। কেন বুলেট এখনো রয়ে গেছে, সে প্রশ্নে চিকিৎসকরা তাকে বলেছিলেন, গুলি বের করা সম্ভব না এতে তার স্থায়ী পঙ্গু হবার ঝুঁকি রয়েছে।
শাকিল বলছেন, চলাফেরা করতে পারলেও ভারী কাজ করতে পারেন না। ইদানিং গুলির কারণে সমস্যা বাড়ছে। উন্নত চিকিৎসা পেলে গুলিটি বের করা যায় কিনা এই ভাবনাও আছে তার।
তিনি উল্লেখ করেন, এগারো মাসে চিকিৎসার জন্য দেড় লাখ টাকার বেশি তার খরচ হয়েছে। ব্যক্তি উদ্যোগে এক লাখ বিশ হাজার টাকার মতো সহায়তা পেয়েছিলেন। কিন্তু সরকারি কোনো সহায়তা তিনি পাননি। এখন সাড়ে তিন লাখ টাকার মতো ঋণ।
‘সবকিছু মিলে খুব ভোগান্তির মধ্যে আছি। আর্থিকভাবে, পারিবারিকভাবে- আমি খুব সমস্যার মধ্যে আছি। আমার বউ চলে গেছে। ভাবছে আমার শরীরে গুলি বের করতে পারি নাই। আমার একটা ছেলেকে নিয়ে সে আলাদা হয়ে গেছে’ বলছিলেন শাকিল।
শাকিলের সঙ্গে এই আলাপ হয় শ্রিপুর উপজেলা পরিষদে। এদিন তিনি অর্থ সহায়তা পেতে তালিকায় নাম ওঠানোর বিষয়টি খোঁজ করতে যান। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাকে জানায় তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব না হওয়ায় তার নামটি তালিকায় স্থান পায়নি।
অথচ শাকিলের বিষয়টি ছিল আলোচিত। গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে জুলাই আন্দোলনে আহতদের নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রচার করেছিল বিবিসি। সেখানে শাকিলের সমস্যা- সংকটের বিবরণ ছিল।
ওই খবরের পর তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন উপজেলার ছাত্র প্রতিনিধিরা। শাকিল তাদেরকে কাগজপত্র জমা দিয়েছিলেন।
গাজীপুরের শ্রিপুর উপজেলায় জুলাই আন্দোলনে আহতদের তালিকাভুক্তির জন্য তথ্য যাচাইবাছাইয়ের দায়িত্বে আছেন আহত রফিকুল ইসলাম রায়হান। ৫ আগস্ট রায়হানও পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন গাজীপুরের মাওনা এলাকায়।
একই ঘটনাস্থলে গুলিবিদ্ধ শাকিল কেন সরকারি তালিকায় নাম নেই, এ প্রশ্নে রায়হান বলছেন, কাগজপত্র দেওয়ার পর আর যোগাযোগ করেননি যে কারণে তার নামটি হয়ত তালিকায় স্থান পায়নি।
শাকিল বলছেন, তার সঙ্গে যোগাযোগ করে কাগজপত্র চাইলে তিনি গত বছর সেগুলো একজন ছাত্রের কাছে দিয়েছিলেন।
শাকিলের বিষয়টি নিয়ে শ্রীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সজীব আহমেদ বলেন, শাকিলের আহত হওয়ার বিষয়টি প্রশাসন জানে। কিন্তু তার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব হয়নি বলেই তালিকায় নাম আসেনি।
সোমবার উপজেলার এক কর্মকর্তাকে শাকিলের কাগজপত্র নিয়ে বিষয়টি তদারকির দায়িত্ব দেন তিনি।
জুলাই আন্দোলনে গুরুতর আহতদের ৭৫জনকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানো হয়েছে। সরকারি ভাবে নিহতদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে। ক খ ও গ শ্রেণীভুক্ত করে আহতদের তালিকা করে সর্বনিম্ন এ লক্ষ টাকা আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এ বছর বাজেটে ৪০৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
জুলাই আন্দোলনে আহত ও নিহতদের জন্য সরকার বিভিন্ন সুযোগ সুবিধার কথা ঘোষণা দিয়েছে। এসব সুবিধার জন্য আহত ও নিহতের তালিকায় ভুয়া নাম ঢুকে পড়েছে।
জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনও জুলাই আন্দোলনের শহীদ ও আহতদের যাচাই বাছাইয়ের কাজ করছে। ফাউন্ডেশনের হিসেবে এ পর্যন্ত চল্লিশজন আহত এবং চারজন নিহত ব্যক্তির নাম জুলাই আন্দোলনের গেজেট থেকে বাতিল করতে পুনর্বিবেচনার জন্য সুপারিশ করা হয়েছে।
জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কামাল আকবর বলেন, ‘এখন ভুয়াগুলো খুব আসছে বলে আমরা মনে করছি না। কারণ আমরা খুব কঠিন চেক দিয়ে ভেরিফাই করছি।’
জুলাই আহত বা শহীদ পরিবারগুলোর সহায়তার জন্য তারা কাজ করছেন। ইতোমধ্যে বরাদ্দ পাওয়া একশ দশ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে। কিন্তু শহীদ পরিবার এবং আহত সবাইকে এই সহায়তার আওতায় আনা সম্ভব হয়নি।
জুলাই ফাউন্ডেশনে প্রতিনিয়ত আহতরা ভিড় করছেন। এরই মধ্যে গত মঙ্গলবার কার্যালয়ে গিয়ে আহতরা ভাঙচুরও করেছেন।
কামাল আকবর বলেন, ‘একশ দশ কোটি টাকার বেশি আমরা বিতরণ করেছি। এরমধ্যে ৮০৬ জন শহীদ পরিবারকে পাঁচ লক্ষ টাকা করে দেওয়ার কথা, সেটা দিয়েছি। আরো পেপার রেডি হচ্ছে বাকিদের দেব। এছাড়া যে ১৪ হাজার ছয়শ যে এনলিস্টেড আছেন, তাদের মধ্যে ক্যাটাগরি অনুযায়ী ৬,৭৪১ জনকে দিয়েছি। তারপরেও কিন্তু আট হাজারের মতো এখনও বাকী আছে, এই আট হাজারকে যদি আমরা প্রথম ধাপের এক লক্ষ টাকা দিতে চাই তাতেও আমাদের লাগবে ৮৭ কোটি টাকা।’
একদিকে শাকিলের মতো জুলাই আন্দোলনে আহতরা যেমন কোনো সহায়তা পাননি, আবার অনেকে একাধিকবার সহায়তা পেয়েছেন।
এখন তারা আরো সহায়তা, উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়া এবং আহতদের শ্রেণি বা ক্যাটাগরির পরিবর্তনের জন্য চেষ্টা করছেন।
আহতদের একটি অংশের দীর্ঘদিন হাসপাতালে থাকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। চক্ষু বিজ্ঞান হাসপাতাল এবং ঢাকার অর্থোপেডিক হাসপাতালে আহতদের আন্দোলন খবরের শিরোনাম হয়েছে।
এখনো ঢাকার অর্থপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান বা পঙ্গু হাসপাতালে দশজন আহত ভর্তি রয়েছেন। কিন্তু তাদের এ অবস্থায় থাকার প্রয়োজনীতা কতটা- সে প্রশ্ন আছে খোদ আহতদের মধ্যে।
শ্রীপুরের রায়হানও পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেন, জুলাই আহতদের একটি অংশ হাসপাতালে বিভিন্ন অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ছেন, এটি তাদের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে। তার ভাষায় যারা হাসপাতালে সিট নিয়ে ভর্তি আছেন তাদের বেশিরভাগেরই আর থাকার প্রয়োজন নেই।
পঙ্গু হাসপাতালের আহতরা একাধিক বার আলোচনায় এসেছেন আন্দোলন করে। চিকিৎসকরা জুলাই আন্দোলনে আহতদের বিষয়ে কথা বলতে চাইলে একটা অস্বস্তিতে পড়েন। পরিচালক বলেন, এখনো যারা আছেন, চিকিৎসা সাস্ত্রমতে তাদের রিলিজ নিতে পারেন।
হাসপাতালের চিকিৎসকদের ভাষায় তাদের সবার অবস্থাই এখন স্থিতিশীল।
জাতীয় অর্থপেডিক হাসপাতালের পরিচালক মো. আবুল কেনান বলেন, ‘আমরা জুলাই যোদ্ধাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। কিন্তু একটা জাতীয় প্রতিষ্ঠান একটা জরুরি হাসপাতালে যেখানে সারাদেশ থেকে রোগী আসে এবং তারা অনেকেই বিছানা পায় না। এরকম একটা জাতীয় প্রতিষ্ঠানকে একান্ত প্রয়োজন ছাড়া দীর্ঘমেয়াদি অকুপাই করা যুক্তিসঙ্গত নয়।
‘সুস্থ হয় নাই বলে যদি থাকি -তাহলে এমনও হবে অনেকের স্থায়ী অক্ষমতা তৈরি হবে; তাহলে কি সে স্থায়ীভাবে হাসপাতালে থাকবে।’ প্রশ্ন রাখেন পঙ্গু হাসপাতালের পরিচালক।
পঙ্গু হাসপাতালে জুলাই আন্দোলন শুরুর পর ৯০২ জনকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে ৬০৬ জন আহত রোগী ভর্তি ছিলেন। এখনো সেখানে দশজন রোগী ভর্তি রয়েছেন। কেন হাসপাতাল ছাড়তে চান না- এ প্রশ্নে আহতরা দাবি করেন হাসপাতাল ছেড়ে চলে গেলে কেউ আর খবর রাখে না।
শামীম নামে আহত একজন গার্মেন্টসকর্মী বলেন, ‘আমার কি দুই টাকা আছে যে চিকিৎসা করবো। একটা বড়ি কিনে খেতে গেলে বিশ টাকা লাগবে। আমি বিশ টাকা উপার্যন করবো কীভাবে?’
আহত মনির খান নামে একজন বলেন, তিনি বাড়িতে গিয়েছিলেন কিন্তু তারপর সমস্যা হয়েছে কিন্তু কোনো সুচিকিৎসা এবং কেউ খোঁজ রাখে না বিধায় আবার হাসাপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
‘আমি এই জায়গা থেকেই চিকিৎসা পাচ্ছি না, বাড়িতে গিয়ে চিকিৎসা পাবো এর গ্যারান্টি আপনি আমাকে কীভাবে দেবেন বলেন। আমি এগারো মাস ধরে এখানে কেউ খোঁজ খবর নিতে পারে না, আমিতে বাড়িতে যাবো আমার ওই সময় খোঁজটা কে নেবে?’
এমবি